ডা. হালিদা হানুম আখতার
আমি চিকিৎসা পেশা শুরু করি, ১৯৭১ – এর মুক্তিযুদ্ধের সময়েই। আজ মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছি আমরা। কথা বলছি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে। সে সময় দেখতাম, ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে প্রায় ছয়শটি মা মারা যেতো। আর হিসাব করলে দেখা যেতো, একদিনে ২৫টির ওপর মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
এই ক্ষেত্রে দেখা যেতো, গর্ভকালীন সেবার অভাব, কোথায় প্রসব করাবে সেই সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব (প্রসবের জন্য যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান দরকার- হাসপাতাল বা সেবাকেন্দ্র দরকার- এগুলোর অভাব) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর অভাব ইত্যাদি কারণে মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
তবে এই ৫৩ বছরে আমরা মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে এনেছি। প্রতি এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে এখন প্রায় ১৭০ জন মা মারা যায়। দিন হিসাবে চিন্তা করলে ১৪ জন মা একদিনে মারা যায়।
আজ আমাদের আলোচনার মূল বিষয় নিরাপদ মাতৃত্ব।মাতৃমৃত্যুর হার ও গর্ভকালীন জটিলতা কমিয়ে আনতে গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের কী ধরনের সেবা দরকার এবং কীভাবে দরকার- এসব বিষয়েই জানবো।
চারটি সেবা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার
গর্ভের সময় অন্তত চারটি সেবা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার নিতে হবে। এই সেবা কেন নিতে হবে ? এখানে দুটো প্রাণের সুস্থতার বিষয় রয়েছে। একটি মা এবং অপরটি গর্ভের শিশু। দুইটি প্রাণের সুস্থতা নিশ্চিতে, মা-টি গর্ভধারণ করলে তাকে চিকিৎসক বা সেবাকেন্দ্রে নিয়ে চারটি চেকআপ বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার অবশ্যই নিতে হবে।
একজন মা প্রথম সেবাটা নেবেন মাসিক বন্ধ হওয়ার পর, ১৬ সপ্তাহ বা চার মাসে। চার মাস পড়লে তিনি চিকিৎসকের কাছে বা সেবাকেন্দ্রে যাবেন। দ্বিতীয় সেবাটি নেবেন, ২৪ সপ্তাহ বা ছয় মাসে। তৃতীয়টি, ৩২ সপ্তাহ বা আট মাস পড়লে। আর শেষ বা চতুর্থটি, ৩৬ সপ্তাহ বা নয় মাসে নিতে হবে।
এই সময় কী দেখা হয় এবং কী করতে হবে ?
এই সময়ে প্রথম চেকআপে দেখা হয়, গর্ভটি ঠিকমতো রয়েছে কি না, অর্থাৎ জরায়ুতে ভ্রূণটি ঠিকমতো রয়েছে কি না- শিশু ঠিকমতো গর্ভে নড়াচড়া করছে কি না।
এই সময় থেকেই চিকিৎসক বা সেবাদানকারীর সঙ্গে প্রসব পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কোথায় ও কীভাবে প্রসব হবে, সেটি জানবে। এর জন্য যে টাকা-পয়সা জোগাড় করা দরবার সেটিও পরিকল্পনার মধ্যে চলে আসবে। কারণ, চিকিৎসকের কাছে গেলে বা কেন্দ্রে গেলে টাকা লাগবে। ভর্তি হয়ে ডেলিভারি করাতে গেলেও টাকা প্রয়োজন। তাই আমরা প্রথম থেকেই টাকা জমাতে উপদেশ দিই।
আমি সূর্যের হাসিতে কাজ করার সময় ‘মায়ের ব্যাংক’ নামে একটি প্লাস্টিকের ব্যাংক তাদের দিতাম, টাকা জমাতে। এটি তারা প্রসবের সময় ব্যবহার করতে পারতো। এই সময় জন্ম পরিকল্পনা কার্ড তৈরি করেছিলাম। এই কার্ডের প্রথমে প্রসবকালীন খরচের বিষয়টি ছিলো।
এটি বলার কারণ, এই টাকা হাতে না থাকলে অনেক সময় পরিবারের লোকজন অনভিজ্ঞ দাই দিয়ে ডেলিভারি করায়। এর খারাপ দিক হলো, মায়ের কষ্ট হয়, ধাত্রী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণে অনেক সময় মরা শিশু হতে দেখা যায়। এই জন্য টাকা সঞ্চয় করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে ডেলিভারি করাতে হবে। আমি পরামর্শ দেবো, গর্ভের প্রথম থেকেই এই পরিকল্পনা করতে।
এখানে আমার ব্যক্তিগত আরেকটি পরামর্শ থাকবে। আপনারা চিকিৎসকের কাছে গেলে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। আমরা সাধারণত মনে করি, চেকআপের সময় পুরুষের থাকা লাগবে না। তবে স্বামী এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যক্তি। সম্পূর্ণ প্রসবের সময়টিতে তার বিরাট একটি ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং যতবার চিকিৎসকের কাছে যাবেন, স্বামীকে সঙ্গে নেবেন।
চারটি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে আরো পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয়, মায়ের ওজন বাড়ছে কি না, রক্তস্বল্পতা রয়েছে কি না, মায়ের উচ্চতা ঠিক কি না। আমরা জানি, মা খাটো হলে, তার জরায়ুও তেমন থাকে। এই ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত প্রসব হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। শিশুটি গর্ভে বড় হচ্ছে ঠিকই, তবে মায়ের পেলভিস ছোট হলে, প্রসব হতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়। এতে মা ও শিশুর ক্ষতি বা মৃত্যু হতে পারে।
আরো দেখি, মায়ের রক্তচাপ। কোনো বিপদচিহ্ন রয়েছে কি না, সেগুলো সনাক্ত করি। টিটি টিকার দেওয়ার দরকার হলে, সেটি দিই। অন্যান্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিতে হলে, সেটিও দেওয়া হয়। অ্যানিমিয়া থাকলে এর চিকিৎসা দিতে হবে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভিজিটে আমরা দেখি, বাচ্চার স্পন্দন। সে নড়াচড়া ঠিকমতো করছে কি না।
অনেক সময় হেমোরেজ বা অতিরিক্ত রক্তস্রাব হয়ে মা মারা যায়। প্রায় ৩০ শতাংশ মায়ের মৃত্যুর কারণ, ব্লিডিং হওয়া। তাই আগে থেকে ব্লাড ডোনার ঠিক করে রাখতে হবে।
অনেক সময় আপনারা শুনেছেন একলামসিয়া বা খিঁচুনি হয়। রক্তচাপ বেশি থাকলে, পায়ে পানি আসলে এ ধরনের জটিলতা হতে দেখা যায়। এসব জটিলতা এড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো প্রতিরোধ করা না গেলে লেবার পেইন হলে খিঁচুনি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে, আর মায়ের তো থাকেই।
চতুর্থ ভিজিটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখনো বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখি, আমাদের সব মা এই চারটি ভিজিট নিতে আসে না। এই অ্যান্টিনেটাল চেকআপের উদ্দেশ্য হলো জটিলতা হওয়ার আগেই যেন চেকআপ নেওয়া যায়।
আরো কয়েকটি জরুরি বিষয়
অনেক সময় হয়তো প্রসবের সময় মাকে ক্লিনিকে নেওয়া সম্ভব হলো না, হঠাৎ করে ডেলিভারির জন্য কাউকে বাড়িতে ডাকতে হলো- এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে আপনার নাগালের মধ্যে রয়েছে এমন কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঠিক করে রাখতে হবে। এমন ব্যক্তিকে ঠিক করবেন, যাকে ডাকলে পাওয়া যায়। সেই ব্যক্তির নাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা আগে থেকেই রেখে দিতে হবে। সব জায়গাতো আর শহর নয়, অনেক সময় হয়তো নৌকায় আসতে হবে, যানবাহন পাওয়ার জটিলতা রয়েছে। তাই আগে থেকে প্রসব পরিকল্পনা করতে হবে। জন্ম পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এগুলো বিরাট অংশ।
আরেকটি বিষয় হলো, লেবার পেইন উঠলে কীভাবে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাবেন। অ্যাম্বুলেন্সে যাবেন? না কি অন্য কোনো যানবাহনে যাবেন- এগুলো ঠিক করে রাখতে হবে। এই পরিকল্পনাও আগে থেকে করবেন।
এ ছাড়া পরিচিত কোনো মানুষকে আপনার সঙ্গে সেবাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য আগে থেকে বলে রাখতে হবে, যেন কোনো সমস্যা হলে তাকে ডাকা যায়।
আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলতে চাই, সেবাদানকারীদের জন্য। একজন মায়ের প্রসবের সময় হয়ে আসলে, এর তিন থেকে চারদিন আগে তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে, ‘আপনি অমুক তারিখে আসবেন’। বিদেশে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, তারা ফোন, ম্যাসেজ বা ইমেলেইর মাধ্যমে মনে করিয়ে দেয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই বিষয়টি ভীষণ কাজে লাগে। একজন মাকে ফোন করে বলা হলে, সে ভীষণ খুশি হয়। তার অ্যান্টিনেটাল চেকআপ বাদ যায় না।
পরিশেষে এটাই বলবো, একজন মায়ের সুরক্ষা ও নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য গর্ভাবস্থায় চারটি চেকআপ অবশ্যই নিতে হবে। এতে ডেলিভারি সুন্দর হবে এবং একজন মা সুস্থ শিশু নিয়ে সেবাকেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে।
লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ