Thursday, December 12, 2024
spot_img
Homeস্বাস্থ্যকাহননারী স্বাস্থ্যবাল্যবিবাহের কুফল কী?

বাল্যবিবাহের কুফল কী?

ডা. হালিদা হানুম আখতার

বাল্যবিবাহ একটি গুরুতর সমস্যা। একে ইংরেজিতে চাইল্ড ব্রাইড বলা হয়। চাইল্ড মানে শিশু, আর ব্রাইড মানে বধূ। এর মানে একটি শিশুকে আমরা বধূ বানিয়ে ফেলছি। সে অন্য আরেকজন পুরুষের স্ত্রী হয়ে যাচ্ছে।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পরিপূর্ণ যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা কি বিষয়টির জটিলতা সম্পর্কে কখনো গভীরভাবে চিন্তা করি ?

বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে এমন একটি দেশ, যেখানে সর্বোচ্চ শিশু বিবাহ রয়েছে। যদিও আগের তুলনায় বাল্যবিবাহের পরিমাণ কমেছে। আগে ছিল ৬০ শতাংশ, এখন ৫০। আবার যত কিশোরী রয়েছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৫২ শতাংশের। এর মানে, এদের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগে; সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই। নিশ্চয়ই জানা রয়েছে, ইউনিসেফের সংজ্ঞা অনুসারে, ১৮ বছর বয়সের আগে যে কেউই শিশু।

কেন শিশু বলা হচ্ছে ? ঐ বয়স আসা পর্যন্ত মেয়েটির শরীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জন্য শরীরের যে পরিপূর্ণতা দরকার সেটি হয়। সেই সময় তাকে চাপ দিয়ে দিলে হীতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কেমন সেটি ? স্বামীর সঙ্গে চলাফেলার চাপ, একটি বড় পরিবেশে যাওয়ার চাপ, এর মধ্যে কেউ গর্ভধারণ করলে, সেটির চাপ ইত্যাদি মেয়েটির ওপর প্রভাব ফেলছে। এগুলো বড় বোঝা।

গর্ভের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে শুনতে ভালো লাগলেও, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে দেখলে, একজন কিশোরী, যার শরীরে এখনো পূর্ণতা আসেনি, তার জরায়ুর মধ্যে একটি বড় বাচ্চা দিয়ে দিলে সম্পূর্ণ শারীর-মনের ওপর একটি বাড়তি ওজন তৈরি হয়। এই ওজন তার সার্কুলেটরি, হরমোনাল ও ইউট্রাসের সিস্টেমের (প্রক্রিয়ার) ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। সে কিন্তু এখনো বড় হয়নি। তার পেলভিস ১৮ বছরের পরেও ২১ বছর পর্যন্ত বড় হতে থাকে।

সুতরাং একটি ছোট পেলভিসের মধ্যে একটি বড় বাচ্চা ঢুকিয়ে দিলে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বাধাগ্রস্ত প্রসব হতে পারে। পেলভিসের মুখ বড় না হওয়ার কারণে শিশু বের হতে অসুবিধায় পড়বে। শিশুর মাথার হাড় ও মায়ের পেলভিসের হাড় একত্রে চাপ দিলে এবং বেশিক্ষণ সেভাবে থাকলে, রক্ত চলাচল করতে না পেরে জায়গাটি মরে যাবে। এতে মায়ের রেকটোভেজাইনাল ফিসচুলা বা ভাসিকোভাজিনাল ফিসচুলা হতে পারে। এতে মায়ের গা থেকে পায়খানা বা প্রস্রাবের গন্ধ বের হতে থাকবে।

এখন চিন্তা করুন, ১৮-এর কম বছর বয়সী একজন মেয়ে কোলের মধ্যে বাচ্চা, আর তার গা দিয়ে প্রস্রাব বা পায়খানার গন্ধ বের হচ্ছে, তাকে কে ঘরে রাখবে? স্বামী ? রাখবে না। তাকে দুইদিন পরে বলবে, ‘বাপের বাড়ি চলে যাও’। তাই বিষয়টি বেশ শঙ্কার।

মা-বাবারা চিন্তা করে না, এই কম বয়সী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে আমরা কোথায় পাঠাচ্ছি ? এমন জায়গায় পাঠানো হয়, যেখানে হয়তো মেয়েটির গোয়াল ঘরেও জায়গা হয় না। বাপের বাড়ি গিয়ে অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়। হয়তো দেখবেন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানেও মানুষ গন্ধের কারণে থাকতে দেয় না। তাহলে কোথায় যাবে এই মেয়েটি?

আমরা কি ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া এই মেয়েটির করুণ জীবনের জন্য নিজেদের দায়ী মনে করি ? আমরা কি ভাবি আমাদের কী শাস্তি হতে পারে এর জন্য? আজ মিষ্টি কথা বলার দিন নয়। আমি এই সচেতনতাটা সবার মধ্যে তুলতে চাই, আমরা ১৮ বছরের আগে মেয়ে বিয়ে দেবো না।

আমাদের একটি স্লোগান রয়েছে, ‘১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২০ বছরের আগে সন্তান নয়।’ আর দুই সন্তান নেওয়ার আগে ব্যবধান হতে হবে অন্তত তিন বছর। না হলে, মা বা শিশু মারা যেতে পারে। অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা হবে। তখন গর্ভপাত করাতে হতে পারে।

আমরা এতক্ষণ বললাম বিবাহিত কিশোরীর কথা। তবে আমাদের তো আরো কিশোরী রয়েছে। অবিবাহিতদের মধ্যে কখনো গর্ভধারণ হয়ে গেলে, সেখানে কী? আমরা যারা সেবা দিয়ে থাকি, স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলি, তারা জটিলতাগুলো বেশি জানি। আমাদের অনেক রোগী দেখার অভিজ্ঞতা হয়। আর একজন মা-বাবা হয়তো একটি সন্তান দেখে। তাই তুলনাটা করতে পারে না।

সুতরাং আজকের বক্তব্য হবে, দয়া করে আপনারা ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না।

আরেকটি বিষয় হল, ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে গর্ভধারণ হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন হলে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলো। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে মেয়েটির জীবনে যে অগ্রগতি ও ক্ষমতায়ন, সেটি বাধাগ্রস্ত হওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।

এসব বিষয় আমরা আগাম চিন্তা না করে, শিশুটির কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটাই ভেবে বিয়ে দিই। আমি মনে করি, এটি বিরাট বড় অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত।

তাই মা-বাবা, সমাজ ও পরিবারের কাছে, আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে, যারা শিশুটির দায়িত্বে রয়েছেন, তারা দয়া করে অভিভাবক বা গার্জিয়ান হন। গেট কিপার বা দারোয়ান হবেন না। অভিভাবক হয়ে মেয়েটিকে সহযোগিতা করুন, তাকে বড় হতে সাহায্য করুন। পাশাপাশি নারী ও পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটি যতটুকু সম্ভব কমিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তবেই আমরা সুস্থ পরিবার ও দেশ পাবো এবং সুস্থ একজন মেয়েকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো।

লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

ডা. হালিদা হানুম আখতার
ডা. হালিদা হানুম আখতার;রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments