রফিক-উল-আলম
‘এ আবার কী কথা, বউটার বাচ্চা হয় না, তাতে আমার কী-ই বা করার রয়েছে?’ আমাদের দেশের একশ্রেণির পুরুষের মাঝে প্রায়ই এমন মনোভাব দেখা যায়। এ দেশের একশ্রেণির স্বামীদের ভেতর এমন মনোভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসে রয়েছে।
এদের বেশির ভাগেরই ‘ইনফার্টিলিটি সমস্যা’ সম্পর্কে মোটেই ধারণা নেই, এমনকি এ ক্ষেত্রে তাদের করণীয় সম্পর্কেও নেই বিন্দুমাত্র সচেতনতা। একশ্রেণির পুরুষ রয়েছেন; যারা মনে করেন, বিছানায় তিনি এক দাপুটে স্বামী। সুতরাং সন্তান না হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো দায় থাকতেই পারে না– অনেক সাধের বিয়ে করা ‘বউ’টাই এর জন্য একমাত্র দায়ী। যদিও পরে দেখা যাচ্ছে, নানা রকম স্পার্মজনিত সমস্যাসহ এদের ভেতর অনেকেই সেক্সচুয়াল ডিসফাংশনে-প্রিম্যাচিউরড্ ইজাকুলেশন-সঙ্গমপূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই বীর্যোস্খলন, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা ED-পুরুষাঙ্গের উত্থান বা সম্ভোগযোগ্য সবল না হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। এগুলোও সন্তান না হওয়ার পেছনের অন্তরায়। অথচ এরাই নির্দ্বিধায় স্ত্রী’কে একতরফাভাবে নিরন্তর গিনিপিগ বানিয়ে চলেছেন– এতে পারিবারিক, সামাজিকভাবে এমনকি নিজ সংসারেও নারী হন হেয়; নিত্য মানসিক পীড়নে হন ক্ষতবিক্ষত!
তাই তো সন্তানপ্রত্যাশী পুরুষকে বলব, সর্বাগ্রে এই দুটো বিষয়কে মাথায় গেঁথে রাখুন-
১. সন্তান না হওয়ার পেছনে শুধু আপনার স্ত্রী নন, বরং আপনারও এমন অনেক সমস্যা থাকতে পারে; যা আপনাদের সন্তান না হওয়ার পেছনের অন্তরায় হতে পারে। তাই আপনার সমস্যা চিহ্নিতকরণে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার সিমেন টেস্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেশনে কোনো গাফিলতি না করে নির্দ্বিধায় করিয়ে ফেলুন।
২. স্ত্রীর সমস্যা চিহ্নিত হলে সে ক্ষেত্রে সমস্ত চিন্তা-চেতনায়, মন-মনন তাঁর পাশে আরও নিবিড়ভাবে থাকুন। তার পুরো ইনফার্টিলিটি জার্নিতে তাঁর হাতটি ধরে রাখুন। জেনে রাখুন, ‘Holding Hands Can Relieve Pain.’ মনে রাখবেন, আবেগীয় সহযোগিতাসহ আপনার সব ধরনের সহায়তা আপনার স্ত্রীকে আরও দ্রুত এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
এই কথাগুলো অন্তরে ধারণ করে রাখুন–
মাতৃত্ব মেয়েদের মজ্জাগত। প্রত্যেক নারীই মাতৃত্বের এই আস্বাদ নিতে পাগলপারা হয়ে থাকেন। তাই সন্তান নেওয়ার কথা ভাবার পর যখন দেখেন, তাদের সন্তান হচ্ছে না বা সন্তান ধারণে সমস্যা ধরা পড়ে, তখন তারা ভীষণ দিশেহারা হয়ে পড়েন। একদিকে নিজের সন্তান লাভের উদগ্র বাসনা; অন্যদিকে পরিবার, সমাজের বক্র চাহনি। আর এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপনজন, সবচেয়ে নিরাপদ– নিভৃত কোণ কিন্তু স্বামী– এই আপনিই। তাই সেই হতভাগিনীর সকল আস্থা-ভরসা-বিশ্বাসের স্থানটি যেন সামান্যতম টলে না ওঠে, তা যে আপনাকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখবেন, সন্তানপ্রত্যাশী এক নারীর ‘ইনফার্টিলিটি জার্নি’টা এক ‘রোলার কোস্টার’; প্রতিনিয়ত তা তাঁকে হতাশা, ব্যর্থতা, দুঃখ, বেদনা, ভয়, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, গ্লানি, মর্ম যাতনায় দুমড়েমুচড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে প্রতিটি মুহূর্ত এক নিদারুণ ঘূর্ণিপাকে আছড়ে ফেলছে। ভেবেছেন কি, এরপরও আপনি আপনার নাশতা, জলখাবার, জামা, জুতা সব হাতের কাছেই এগোনো পাচ্ছেন? আর সন্তান না হওয়ার গঞ্জনাটা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আপনার দিক থেকেও একটিবারের জন্যও না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখুন; স্ত্রীকে আবেগিক সাপোর্ট দিয়ে আগলে রাখুন।
সাধারণত বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিয়ে আমরা যারা কাজ করি, ইনফার্টিলিটি গাইডেন্স তথা চিকিৎসার জন্য আমাদের কাছে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে একসঙ্গেই থাকতে হবে, বলে দেওয়া হয়। কিন্তু ‘ও তো খুব ব্যস্ত, অফিসের জন্য আসতে পারেনি’– এমন হেনতেন গালভরা গল্প আমাদের হরদম বিহ্বল করে! ডাক্তারের আপয়েন্টমেন্টে, চিকিৎসায়, কাউন্সেলিং, গাইডেন্সে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী প্রবরটি থাকলে একদিকে যেমন স্ত্রীটি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে; ঠিক তেমনি স্বামীর সমস্যা, মনোভাব ইত্যাদি চিকিৎসা বা কাউন্সেলিংয়ের জন্যও অতি অপরিহার্য। তাই স্ত্রীকে একা একা যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে ঠেলে দেওয়া অবুঝ স্বামীদের বলব– আরেকবার মাথায় রাখুন, সন্তানের বিষয়টি স্ত্রীর একার নয়। আর আপনি শুধু একাই অফিস বা ব্যবসা নিয়ে ব্যাপৃত নন, আরও অনেকেই এসব করেও স্ত্রীর প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গেই আসছেন। সবার আগে আপনার ‘প্রায়োরিটি’ নির্ধারণ করুন, আপনার সন্তান প্রয়োজন কিনা? যদি মন বলে ‘না’, তবে শুধু শুধু স্ত্রীকেই বা একাকী ঠেলে দেওয়া কেন! বরং আপনার প্রিয় মাতা, ভগ্নি, ভ্রাতা, পরিবার ও সংশ্লিষ্ট সমাজকে সদর্পে আপনার ইচ্ছাটি ঘোষণা দিয়ে দিন। এতে করে অন্তত সেই বেচারী দায়মুক্ত হবেন। আর যদি সত্যিকার অর্থে আপনারও সন্তান লাভের ইচ্ছা থেকে থাকে, ওসব খোঁড়া যুক্তি শিকেয় তুলে ‘মানিক-জোর’ হয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিটি পদেক্ষেপে স্ত্রীর সঙ্গে, তাঁর পাশেই থাকুন।
চলবে…
লেখক : ইনফার্টিলিটি কাউন্সেলর ;
ইম্পালস হাসপাতাল, ঢাকা