ডা. হালিদা হানুম আখতার
আমরা জানি, তামাক সেবন একটি প্রাণঘাতী বিষয়। বাংলাদেশে এর প্রকোপ অনেক। দেখা যাচ্ছে, ১৫ বছরের ওপরে প্রাপ্ত বয়স্ক যারা রয়েছে, তাদের ৩৫ শতাংশের বেশি ধূমপান করে বা তামাক গ্রহণ করে। এর মধ্যে পুরুষ ৪৬ শতাংশ, নারী ২৫ শতাংশ।
আমরা এটিও জানি, যারা তামাক গ্রহণ করছে, তাদের অর্ধেকের মৃত্যু হয়ে যায় বা মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক থাকে। পাশাপাশি রোগের ঝুঁকিও বাড়ে। এই রোগের জন্য, তাদের চিকিৎসার জন্য যে ব্যয়, সেটা একটা বিরাট টাকার অংশ। যারা অতো ধনী নয়, তারা ভুগে ভুগে তাড়াতাড়ি মারা যায়। সুতরাং এটা বড় বিষয়। আবার যারা সেবা দিচ্ছে, তাদের জন্যও রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তাহলে এখন আলোচনার বিষয়, একটি দেশে কীভাবে আমরা তামাক সেবন কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি। কী কী পথ অবলম্বন করলে সেটি কমিয়ে নিয়ে আসা যায়।
তামাক প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, একটি দেশে কারা বেশি ধূমপান করছে, সে বিষয়ে সমীক্ষা করা। একে গ্যাটস বলা হচ্ছে। এটি জানার পরে কীভাবে তামাক গ্রহণ থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসা যায়, অর্থাৎ কীভাবে ও কাদের কাউন্সেলিং করা যায় -এই বিষয়ে একটি নির্দেশনা তৈরি করা। যারা তামাক সেবন করছে, তাকে কোন পদ্ধতিতে এটি থেকে বিরত করা যায়, সেই বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহায্য করা। তামাক সেবন একজন ব্যক্তির দেহে কত রকম ক্ষতি করছে, এটি তাকে জানানো।
আরেকটি হলো, যারা সিগারেট বা বিড়ি তৈরি করে, বিভিন্ন ধরনের তামাক সেবনের পথ তৈরি করে, তাদের যে বিজ্ঞাপন রয়েছে, সেগুলো কীভাবে কমিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে, সেটি চিন্তা করা। অন্য আরেকটি বিষয় হলো, সিগারেট বা বিড়ির ওপর বেশি কর বসানো হলে হয়তো এটি গ্রহণ কমিয়ে নিয়ে আসতে পারা যাবে।
এরকম কতগুলো বিষয় সারা পৃথিবী করছে। কেউ বেশি করছে, কেউ কম করছে। কিছু দেশ রয়েছে যারা সফল হয়েছে এবং এটি নিয়ে তারা অনেক এগিয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপনের গায়ে ঠিকই লেখা রয়েছে যে তামাক আপনার ক্ষতি করবে। তবুও সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। এই বিক্রির বিষয়টা কমিয়ে নিয়ে আসা। গুল খেলে যে মুখে ক্যানসার হতে পারে, এটি মানুষকে বলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, তুমি এই সমস্যায় পড়তে পারো। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়ি-ঘর বিক্রি করতে হতে পারে। সন্তানরা আরো গরিব হয়ে যাবে। এইসব তথ্যগুলো তামাক গ্রহণকারীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
আবার কর বাড়ালে হয়তো সরকারের লাভ হলো। একদম নিম্নবিত্তরা হয়তো কিনছে না। তবে একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এতে অনেকেই কম দামের জিনিস ব্যবহার করা শুরু করবে। এতে ক্ষতি। তাই ব্যক্তি বিশেষে তথ্য দিতে হবে, সাহায্য করতে হবে যেন তারা তামাক সেবন বন্ধ করে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
আমি নারী স্বাস্থ্যের মানুষ হিসেবে ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি কয়েকটি পর্যায় বা ভাগে দেখি। একটি হলো, ওই ব্যক্তি যে তামাক গ্রহণ করছে, সে নারী বা পুরুষ হোক, তাকে সাবধান করা। আরেকটি হলো, তার পরিবারে যারা রয়েছে, তাদের বিষয়টির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানানো। এরপর আশেপাশে যে কমিউনিটি রয়েছে, তারা নিজেরা সচেতন হবে এবং অন্যকে সতর্ক করবে। আরেকটি হলো প্রতিষ্ঠান। স্কুল-কলেজ ইত্যাদি। তারা জানবে এবং অন্যদের সচেতন করবে। এরপর হলো সরকার। সরকার তার নিজস্ব জনগণকে সুস্থ রাখার জন্য যে চেষ্টা করছে তার জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। সেগুলো আবার সুষ্ঠুভাবে পালন হচ্ছে কিনা- এই বিষয়ে তদারকি করা প্রয়োজন।
স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বলা যায়, ‘তোমার পরিবারের ব্যক্তিদের তামাক সেবনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলবে। তাদের তুমি প্রেরণা দিবে এটি বন্ধ করার জন্য।’ সুতরাং এই শিক্ষার্থীদের আজকে তথ্যটা দিলে তারা সবসময় এটি নিয়ে কাজ করবে। আবার পরিবারের লোকদেরও বলতে হবে।
অনেকে তামাককে হালকা জিনিস মনে করে। তবে এটি যে ক্ষতিকর ও প্রাণঘাতী সেটা বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
রাস্তাঘাটে সিগারেটের যে বড় বড় ব্যানার দেয়, এর পাশাপাশি তামাক গ্রহণের ক্ষতিকর দিকগুলোর ছবিও দিতে হবে। এগুলো সাধারণ দেখা যায় না।
তামাক প্রতিরোধে ব্যক্তি, কমিউনিটি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে দায়িত্ববান হতে হবে। সরকারকে সচেতন করতে হবে এবং সরকারের কাছে দাবিও জানাতে হবে এগুলো প্রতিরোধে।
বলতে হবে, ‘সিগারেট বা তামাক খেও না। তাহলে তোমার শরীরে যে ক্ষতি হবে, সেটি অপূরণীয়’।
লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ