Wednesday, January 22, 2025
spot_img
Homeস্বাস্থ্যকাহননারী স্বাস্থ্যকিশোরী নির্যাতন কেন হচ্ছে, প্রতিরোধ কেন জরুরি ?

কিশোরী নির্যাতন কেন হচ্ছে, প্রতিরোধ কেন জরুরি ?

ডা. হালিদা হানুম আখতার

আজ নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কথা বলতে চাই। ২০২২ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এখানে বলা হয়, নারীর জন্য নিরাপদ কোনো স্থান নেই। ঘরে-বাহিরে নির্বিশেষে কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন বেড়েই যাচ্ছে।

কেবল মে মাসেই ধর্ষনের শিকার হয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে চারজন কিশোরীসহ ১০জন প্রতিবন্ধী। দলবদ্ধ ধর্ষনের শিকার হয়েছে একজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও দুইজন নারী।

তাই বলা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা কিন্তু বেড়েই চলেছে। কমেনি। কমার কোনো পরিসংখ্যান পাইনি। তাহলে নারী কোথায় নিরাপদ এটা আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং কোথায় সে নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছে, সেটি জানতে হবে।

আর এই বিষয়ে নারীকে দোষ দিলে হবে না। নির্যাতনের শিকার যে হয়, সে তো দোষী নয়। তাকে নির্যাতন যে করে তার সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় নারী কোথাও গেলে, রাস্তায় গেলে, বাসে চড়লে, স্কুলে যাওয়ার পথে ধর্ষনের শিকার হয়। তাহলে সে যাবে কোথায় ? আর আমাদের মতো উন্নতিকামী বাংলাদেশে নারী কেন ঝুঁকিতে থাকবে ? নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকবে ? এই প্রশ্নগুলো কি আমরা নিজেরা নিজেদের করতে পারি ? আমার মনে হয়, আজ সময় এসেছে এসব প্রশ্ন বার বার করার।

একজন কিশোরীর কথা চিন্তা করি। কিশোরীকে তো স্কুলে যেতে হবে। আবার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অনেক কিশোরী চাকরি বা কাজ করছে। বাড়িতে কাজ করছে। বাড়িতে একজন কিশোরী কাজ করলে তার ওপর সহিংসতার পরিমাণ চিন্তার বাহিরে। এসব নিয়ে অনেক পরিসংখ্যান রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স ২০১১ ও ২০১৫ সালে সমীক্ষা করেছে। ২০১৫- এর সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, প্রায় ৪৩ শতাংশ কিশোরী, যারা বিবাহিত, তারা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এই সহিংসতার ধরন মারপিট হতে পারে, আর্থিক হতে পারে, যৌন নির্যাতন হতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছ, দুই জনের মধ্যে একজন বিবাহিত কিশোরী, তার জীবদ্দশায় সহিংসতার শিকার হয়। তাহলে, সেই নারী কোথায় যাবে? বা কোথায় রয়েছে ? চিন্তা করুন।

আর যারা বিবাহিত নয়, তারা যখন বাহিরে যাচ্ছে, তারা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তারা পথের মধ্যে ধর্ষনের শিকার হয়। একজন দিয়ে নয়, দলবদ্ধ ধর্ষনের শিকার হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষিতা নারীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। মেরে তাকে, জমিতে বা পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। মেয়েটি যে একজন মানুষ সেটাই যেন আমরা ভুলে যাই। একজন নারী বা কিশোরী যে একজন মানুষ আমরা কেমন করে ভুলে যাই? নিজেদের প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। তাই, এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক পরিবর্তন দরকার। আমাদের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

আবার একজন ধর্ষককে হয়তো আইনগতভাবে ধরা হল। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। তবে তার শাস্তিটা কী হচ্ছে, সেটি কিন্তু জানতে পারছি না। শাস্তি না দেখানো হলে কিন্তু এসব অপরাধ কমবে না।

বাহিরের দেশগুলোতে দেখবেন, আপনি খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ম্যাসেজ চলে আসে ‘ তুমি স্পিডে গাড়ি চালিয়েছো, তোমার ফাইন হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই টাকা না দিলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে।’ এটি হল শাস্তি।

এখন একজন মানুষ আরেকজনকে মেরে ফেললে তার কী শাস্তি হচ্ছে, আমরা কিন্তু জানতে পারি না। ধরা পড়া বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এই পর্যন্ত জানি। তবে তার শাস্তিটি জনসম্মুখে না দিতে পারলে অপরাধ বন্ধ হবে না।

আমাদের এই নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সবার দায়িত্ব এটি বন্ধ করা। কোনো অবস্থাতেই একজন নারীকে আমরা নির্যাতনের শিকার দেখতে চাই না।

তবে, এটিতো গেলে মারামারি-কাটাকাটি ধরনের সহিংসতা। এবার আরেকটি দিকও বলতে চাই। আরেকটি বিষয় হল, একজন নারীকে আমরা ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিয়ে দিই। এটি একটি নির্যাতন। ১৮ বছরের আগে তাকে গর্ভধারণে বাধ্য করা হচ্ছে, এটি আরেক ধরনের নির্যাতন। গর্ভধারণের পর চারবার অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, সেটি দেওয়া হচ্ছে না। তার বাড়িতে থাকা যে অভিভাবক, সে হয়তো বলছে ‘আমাদের তো এভাবেই ১৪টা বাচ্চা হয়েছে, আমাদের তো হাসপাতালে যেতে হয় নাই। তোমাকে প্রথম বাচ্চাতেই এতো হাসপাতালে যেতে হবে কেন?’ এটি বন্ধ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভাবস্থায় অন্তত পক্ষে চারবার চিকিৎসক দেখিয়ে চেকআপ বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার জরুরি। না হলে মেয়েটির মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে। আরেকটি বিষয় হল, মেয়েটির প্রসব বাড়িতে করা যাবে না। তার প্রসব একটি ক্লিনিক্যাল জায়গাতে করাতে হবে, যেখানে চিকিৎসক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন। না হলে একেও নির্যাতন বলতে হবে।

সুতরাং, বাড়িতে যে অভিভাক রয়েছে (স্বামী, শাশুড়ি বা অন্যান্য) তাদের সবার দায়িত্ব হবে মেয়েটিকে সেবাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।

সন্তান প্রসবের সময় কিশোরীর করুণ মৃত্যুর অনেক ঘটনা রয়েছে। এগুলো গল্প নয়। বাস্তব ঘটনা। মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে দাই দিয়ে প্রসব করানো হয়েছে। তবে ফুল পড়েনি। ফুল বের করতে নাড়ি ধরে টান দেওয়া হয়েছে। এতে রক্তপাত হয়ে মা মারা গেছে। আবার হয়তো খাঁমচি দিয়ে ফুল বের করা হল, কিছুক্ষণ পর মেয়েটি মারা গেলো। এসব হল নির্যাতন। এগুলো থেকে নারীকে বাঁচাতে হবে।

এসবের দায়িত্ব কিন্তু মেয়েটির পরিবারের। কারণ, সে তো একজন বাচ্চা মেয়ে। পরিবার তাকে ছোটবেলায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তাকে সন্তান হওয়ার জন্য বাধ্য করছে। আবার চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যাচ্ছে না। তার পেছনে টাকা খরচ করতে চাইছে না। এগুলো সব নির্যাতনের সংজ্ঞায় পড়ে।

তাই সবার প্রতি ভীষণভাবে নিবেদন থাকবে, কিশোরীর যে প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকার, সেটি তাকে দিতে হবে। তার লেখাপড়া, ভালো খাবার খাওয়া, সেবা পাওয়ার অধিকার তাকে দেওয়া প্রয়োজন। না হলে আমরা অপরাধ করবো। নির্যাতনের পর্যায়ে আমাদের কাজটি পড়ে যাবে। তখন নির্যাতনের জন্য কোনো শাস্তি থাকলে, সেটি আমাদেরও হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

ডা. হালিদা হানুম আখতার
ডা. হালিদা হানুম আখতার;রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments