রফিক-উল-আলম
শুরু হলো পবিত্র কোরবানি ঈদের এক লম্বা ছুটি। তাই তো সাতকাহনের সন্তানপ্রত্যাশী পাঠকের জন্য এই সময়টি কাজে লাগিয়ে কীভাবে গর্ভধারণের প্রচেষ্টা চালানো যায়, তা বলতে আমিও চলে এলাম।
‘বন্ধ্যত্বের সমাধান’ একটি লক্ষ্য লাভের পথ। তাই তো সুইচ টেপার মতো যখন ইচ্ছে এই পথচলা বন্ধ করে দিলাম বা ইচ্ছামতো চালু করলাম– বিষয়টি এমন নয়। এ ক্ষেত্রে সেসবের কোনো পথই নেই। হুট করেই এই যাত্রা থামিয়ে দেওয়া মানেই পিছিয়ে যাওয়া; লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া।
তাই তো এবারের ঈদের এই লম্বা ছুটিতে, ঘোরাফেরা, আনন্দ, সামাজিকতা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই সঙ্গে চলবে সন্তানপ্রত্যাশীদের গর্ভধারণের প্রচেষ্টাও।
১. কর্মময় ও যান্ত্রিক জীবনের মাঝে ছুটি মানেই একঝলক মানসিক প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে প্রাণ-মনকে এক সুশীতল আবহে ভরিয়ে তোলা। উৎসবের এই সময়টিতে দম্পতিদের বন্ধ্যত্ব বিষয়ক মানসিক চাপ তুলনামূলকভাবে কমে যায়।
ঈদের নানা আনুষ্ঠানিকতা, সাংসারিক বিষয়, পরিবারের ঈদ পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপচারিতা হয়। পারস্পরিক সমঝোতা ও সহায়তার ক্ষেত্রে মানোন্নয়ন ঘটে। দু’জনের রোমান্সের জায়গাটিতেও এটি দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। তাই তো এই সময়টিতে যাদের মাসিকের ডিম্বোস্ফুটনের (ওভুলেশন) সময়, উৎসবের শত ব্যস্ততার মধ্যেও অবশ্যই নিজেদের জন্য সময় বের করে নিতে হবে; শারীরিকভাবে মিলিত হতে হবে। কারণ, তুলনামূলক মানসিক চাপমুক্ত এই সময়টি প্রেগন্যান্সি আসার একটি মোক্ষম সময়।
২০১৯ সালে আমেরিকার একটি অতি জনপ্রিয় প্যারেন্টিং পার্টনার ‘বেবি সেন্টার’ লম্বা ভ্যাকেশনে ছিলেন এমন এক হাজারের বেশি সন্তানপ্রত্যাশীর মধ্যে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, ‘ছুটিকালীন দাম্পত্য মিলন’ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সমীক্ষায় ফলাফলে আরও দেখা যায়, এক হাজার সন্তানপ্রত্যাশী দম্পতির ৪০ ভাগই তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সন্তানলাভে সক্ষম না হলেও ক্রিসমাস ভ্যাকেশন বা বিভিন্ন ছুটিতে এক অপরকে আন্তরিকভাবে সময় দেওয়ার কারণে সন্তান ধারণে সক্ষম হয়েছেন।
সুদূর আমেরিকাতেই নয়, আমার সঙ্গে সেশনকালীন অসংখ্য দম্পতিকে তাদের ওভুলেশন সময়ে ছুটি নিয়ে এমন কিছুটা সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়ে এবং তাদের জন্য একটি ‘কমপ্লিট ছুটিকালীন গাইডলাইন’ তৈরি করে দিয়ে দুর্দান্ত ফল পেয়েছি। কারণ, ছুটির সময় মানসিক চাপ কমে যাওয়া, দম্পতির রোমান্টিকতা বেড়ে যাওয়া, দাম্পত্য সম্পর্কের উন্নয়ন, যৌন চাহিদা বা সেক্স ড্রাইভ বা যৌন আবেদনের বৃদ্ধি, মিলনের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির এমন ম্যাজিক ঘটিয়ে দেয়।
২. সন্তানপ্রত্যাশী যারা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেছেন, সবকিছুর মধ্য থেকে নিজেদের জন্য কিছুটা সময় বের করে নিন। বেরিয়ে পড়ুন শুধু দু’জনে ছেলেবেলার কোনো বন্ধুর খোঁজে; গ্রামীণ মেঠোপথে, নদীর ধারে, পুকুরপাড়ে বা রাতের খোলা আকাশের নিচে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একে অন্যকে করে ফেলবেন নতুন করে আবিষ্কার।
একই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ওষুধপত্র, ওজন নিয়ন্ত্রণ, হাঁটা, ফার্টিলিটি ম্যাসাজ, এক্সারসাইজ, অর্থাৎ নিজেদের ফার্টিলিটি অবস্থা বাড়ানোর জন্য যার যার চিকিৎসক, ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ যেভাবে যা পরামর্শ দিয়েছেন, মনে রাখতে হবে। ছুটিতে বিভোর থেকে সেসব যেন ভুলে না যাওয়া হয়।
৩. সন্তানপ্রত্যাশী যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের কারণে যাদের কিছু খাবারে বারণ রয়েছে, উৎসবের সময় বলে কথা, অতটা তো আর নির্দয় হওয়া যায় না– এমন ভাবলে তবু মনে করিয়ে দেব, সিম্পল কার্বোহাইড্রেট, অর্থাৎ পোলাও, ভাত, আলু, আটা, রুটি, পাস্তা, নুডলস, চিনি বা মিষ্টিজাত খাবারে মুখ সামলে চলুন। তবে কমপ্লেক্ট কার্বােহাইড্রেট, যাতে ফাইবার কনটেন্ট বেশি, যেমন– ব্রাউন রাইস ও লাল আটার রুটি (পরিমিত) ওটস খাওয়া তো যেতেই পারে।
‘কোরবানির মাংস? তা কি বাদ বলা যায়’– এমনটাও বললে পরামর্শ দেবো অতি পরিমিতভাবে খেতে। আর চর্বি যত এড়াবেন, তত ভালো। মিষ্টি কম খেতে বলেছি বলে ঈদের সময় কোল্ড ডিংকস খাবেন? উহু মোটেও নয়। পারতপক্ষে এসব বোতলজাত ঠান্ডা পানীয়, জাঙ্ক ফুড, ক্যানড ফুড, ভাজা-পোড়া এগুলো থেকেও কিন্তু থাকতে হবে বেশ তফাতেই।
পুষ্টি ঠিক রাখতে নিশ্চয়ই চলবে ডিম, মুরগির মাংস, ডালসহ সব ধরনের প্রোটিন। তবে ইউরিক এসিড বৃদ্ধিজনিত সমস্যা এবং কিডনির কোনো সমস্যা থাকলে বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে আপনার চিকিৎসক প্রোটিন গ্রহণে নিষেধ বা পরিমিত করলে, সে অনুযায়ী চলতে হবে। টাটকা ফলমূল, সবজি, সালাদ যে চলবে বিন্দাস, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোদ্দাকথা, ঈদের লম্বা ছুটিতে আনন্দে থাকুন, চাপমুক্ত থাকুন। গর্ভধারণের জন্য এই মানসিক সুস্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো অনেকেই এই সময়টি কাজে লাগিয়ে এক ডুবে হয়ে যাবে বন্ধ্যত্ব নদী পার। পেয়ে যাবেন গর্ভধারণের আনন্দ অপার।
লেখক :
ইনফার্টিলিটি ও আইভিএফ কাউন্সেলর
ইমপালস হাসপাতাল, ঢাকা