ডা. হালিদা হানুম আখতার
আজ আবারও আমি মাতৃমৃত্যুর কথা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যখন নিরাপদ মাতৃত্ব কথা চিন্তা করবো, তখন মাতৃমৃত্যুর কথা এসেই যাবে।
২০১৬ সালে আমাদের যে মেটারনাল মর্টালিটি সার্ভে হয়েছিল, এর তথ্য নিলে দেখা যাবে কী কী কারণে একজন মা-কে তার গর্ভের কারণে মারা যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় যে কারণ, সেটা হলো অতিরিক্ত রক্তপাত। এটি ২৯ শতাংশ। আরেকটি হলো, একলামসিয়া বা খিঁচুনি। আবার তার আগের কোনো রোগ থাকলে যেমন ডায়াবেটিস বা হার্টের কোনো রোগ বা কিডনির কোনো রোগ থাকলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা হতে পারে।
তবে আরেকটি বিষয় রয়েছে, যেটি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। এটি হলো, গর্ভপাতের জটিলতা। গর্ভপাত অনেক সময় এতো জটিল হয়ে যায়, এতে মাকে মারা যেতে হয়। এটি সাত শতাংশ। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ২০১০-এ যে সমীক্ষাটা করা হলো, এতে দেখা গেছে, এক শতাংশ মারা গেছে। তবে পরে সেটি বেড়ে গিয়ে সাত শতাংশ হয়েছে। এর মানে ১০০টি মা মারা গেলে সাতটি মা মারা যাচ্ছে গর্ভপাতের জটিলতায়।
গর্ভপাতকে ইংরেজিতে আমরা অনেক সময় অ্যাবরশন বলি। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে গর্ভপাত কেন হচ্ছে? কেন একটি নারীকে গর্ভপাত করাতে হচ্ছে? আমরা যেটি বুঝি, একটি মা গর্ভধারণ করেছে, তবে এই সন্তানটি সে চাচ্ছে না। এই না চাওয়াটা যেকোনো কারণে হতে পারে। তার ব্যক্তিগত কারণে হতে পারে। সে হয়তো লেখাপড়া করছে, এখন সন্তান নেওয়ার সময় নয় বা তার বয়স খুব কম, আরো দেরি করে বাচ্চা নিতে চায়- এইরকম। এসব অবস্থায় তখন তারা বিভিন্ন জায়গায় যায় এই গর্ভকে বাদ দেওয়ার জন্য।
এখন কীভাবে বুঝবে একজন নারী গর্ভধারণ করেছে? সে জানে তার মাসিকটা বন্ধ হয়ে যাবে। সে ঐ সময় গর্ভটা না চাইলে তার জন্য এটি একটি চিন্তার বিষয়। তখন বিষয়টি সেই নারীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তার টাকা-পয়সা থাকলে সে কোনো ক্লিনিকে গিয়ে ব্যবস্থাটা নিয়ে নেয়। তবে যে দরিদ্র, যার কাছে তথ্য নেই, যার কাছে শিক্ষা না থাকার কারণে সে জানে না যে কোথায় যেতে হবে, তার জন্য সেটি একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
আমি কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গ্রামের মানুষ অনেক সময় এই ক্ষেত্রে কবিরাজের কাছে যায় বা যারা গাছ-পালা নিয়ে সেবা দেয়, তাদের কাছে যায়। তখন তারা হয়তো গাছের শিকড় দিলো, বা গাছের শিকড় থেকে বের করা এমন একটি ওষুধ দিলো, যেটা ব্যবহার করলে, খেলে বা সেই কাঠিটি তার শরীরে ঢুকালে গর্ভপাত হয়ে যাবে। এই রকম একটি অবস্থা তখন হয়ে যায়। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিষয়টি না করলে জটিলতা বেশি হয়। এই জটিলতার কারণে মা-কে মারা যেতে হয়।
জটিলতাটা কী হতে পারে? সংক্রমণ, সেপটিসিমিয়া ও সেপটিক হতে পারে। ভীষণ জ্বর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সময় ভালো চিকিৎসা না হলে সে মারা যেতে পারে।
অনেক সময় কাঠি ঢুকিয়ে দেয় জরায়ুতে। যারা কাজটি করে তারা তো আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। তখন কাঠিটি দিয়ে জরায়ু ফুটো হয়ে যায়। তখন পেরিটোনাইটিস হয়ে যায়। ভীষণ জটিল একটি অবস্থা হয়ে, সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় আমরা দেখি, টিটিনাস হয়ে যায়। তখন রোগীর মৃত্যু হয়। এই অবস্থাটি আমরা চাই না।
গবেষণায় দেখেছি, যত নারী গর্ভধারণ করছে, তার ৪৮ শতাংশ বলছে আমি এটি চাচ্ছি না। তো অনেক কারণেই নারীর মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এখন আলোচনার বিষয় হলো, কী করতে হবে? আপনারা জানেন, আমাদের খুব নামকরা একটি পরিবার-পরিকল্পনা প্রোগরাম রয়েছে। আমাদের এখন ৬০ শতাংশ দম্পতি পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে এরপরও দেখা গেছে, এই পদ্ধতি যাদের গ্রহণ করা বেশি দরকার, এমন ১০ শতাংশ এটি নিচ্ছে না। তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হচ্ছে।
তাহলে আমি একটু বলতে চাই, এটি সবারই জানা দরকার, আমাদের মাসিক নিয়ন্ত্রণ বলে একটি প্রোগরাম রয়েছে। ১৯৭৪ সাল থেকে আমরা অল্প করে এটি শুরু করেছি, পরে ১৯৭৬ সালে এটি আরেকটু বিস্মৃত হয়েছে। ১৯৭৯ সালে সরকার একে সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছে। যারা প্যারামেডিকেল ছিলো তাদের এমআর-এর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এমআর কী? এটি হলো, মাসিক নিয়ন্ত্রণের একটি ব্যবস্থা। একটি ছোট প্লাস্টিক সিরিঞ্জের মাধ্যমে পাতলা স্ট্র দিয়ে টানা হয়, তখন ভেতরে যে তরল পদার্থটি রয়েছে, সেটি বের হয়ে আসে। মাসিক বন্ধ হওয়ার আট বা নয় সপ্তাহের মধ্যে এটি আমাদের করা সম্ভব। সরকার একে পরিবার-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রচলন করেন। প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক প্যারামেডিক এই ব্যবস্থা দিয়ে আসছে। যদিও আমরা দেখছি গত ১০ বছরে এই ব্যবস্থা দেওয়ার সংখ্যাটা কমে এসেছে, এর জন্য গর্ভপাতের জটিলতার সংখ্যাটা বেড়েছে। আমরা জানি, এমআর বা মিন্সট্রুয়াল রেগুলোশনের সংখ্যা কমে যাওয়াতে গর্ভপাতের জটিলতার কারণে মৃত্যু বাড়ছে। তো আমি জনগণের জানার জন্য বলছি, আপনি সরকারি যেকোনো জায়গায় গিয়ে বলবেন, ‘আমি এমআর করতে চাই’। তাহলে তারা এমআর-এর ব্যবস্থা করে দেবে।
২০১৪ সালে সরকার আরেকটি নতুন পদ্ধতি এনেছে। সেটি হলো, খাওয়ার বড়ি। এই বড়ির মাধ্যমেও মাসিক নিয়ন্ত্রণ করানো যায়। তবে সেটি নয় সপ্তাহ পর্যন্ত করানো যায়। ফামের্সিতে গেলেও বলতে পারেন, ‘আমার মাসিক বন্ধ রয়েছে, এটি আমার চালু করতে চাই।
এই জন্য কী ওষুধ রয়েছে?’ তখন তারা আপনাকে ওষুধ দেবে। ওষুধের বক্সে সব লেখা থাকে কীভাবে খেতে হবে বা কী করতে হবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। এই ওষুধ আসার পরে অনেক সহজ হয়েছে।
সুতরাং এসব বিষয় জেনে নিজের মতো ব্যবস্থাপনা নিতে পারলে ভালো। আমাদের দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এটি দিচ্ছে। যেমন, মেরিস্টোপ নামে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা এই সেবা দেয়। তাদের যত ক্লিনিক রয়েছে, এখান থেকেই সেবা দেয়। প্রায় ৬০ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিচ্ছে। তাই কবিরাজ বা উল্টোপাল্টা কারো কাছে না গিয়ে আপনারা সঠিক প্রতিষ্ঠানে গেলে জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না। নারী মারা যাবে না। আমরা মনে করি, এটি নারী ক্ষমতায়নেরও একটি বিরাট বড় বিষয়। আমি আপনাদের আবারও বলছি, এটি সরকারের অনুমতি করা একটি পদ্ধতি। একে আমরা মিস্টুয়াল রেগুলেশন বা মাসিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলি।
সুতরাং নিজের জীবনকে সুন্দর রাখার জন্য, নিজের জীবন যেন বিপথগামী না হয় বা জটিলতার মধ্যে না পড়ে, এর জন্য আমার মনে হয়, এই মাসিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার জানা দরকার। প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
আমার এটি বলার উদ্দেশ্য হলো, এই মাসিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা আমি অনেক আগে শিখেছি এবং শিখে মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি ও ট্রেনিং সেন্টারে প্রথম চিকিৎসক হিসেবে এমআর শুরু করি। এরপর এটি সরকার পর্যায়ে যায়। ধীরে ধীরে এর বিস্মৃতি বাড়ে। এটি যে কত নারীকে বাঁচিয়েছে এবং মাতৃত্বকে কত নিরাপদ করেছে এটি বলার কোনো শেষ নেই। তাই বিষয়টি জানিয়ে আমি আপনাদের সচেতন করতে চাই।
লেখক: রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ