ডা. হালিদা হানুম আখতার
আজ আমাদের বিশেষভাবে আলোচনার বিষয় বাল্যবিবাহকে আমরা প্রতিরোধ করবো কীভাবে? কারণ, একে বন্ধ করতে হবে, প্রতিরোধ করা জরুরি। এর জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার খুবই প্রয়োজন।
বাল্যবিবাহ একটি চুক্তি। একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে এই চুক্তি হয়। এই চুক্তি হতে পারে, শুধু যারা সাবালক তাদের। আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী একজন নারী ১৮ বছর হলে তবে সাবালিকা হবে। একজন পুরুষ ২১ বছর হলে তবে সাবালক হয়। নারীর বয়স ১৮ এর আগে বিয়ে দেওয়া হলে, সে সাবালক হলো না এবং সে চুক্তির যোগ্যও হলো না।
একটি ছেলের ২১ এর কম বয়স হলে সে সাবালক হলো না, তার চুক্তিটি গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই জন্য আমাদের এই জিনিসগুলো বুঝতে হবে। আইনগত ব্যবস্থাগুলো জানতে হবে। সেই জন্য আমরা চিন্তা করি ছোট অবস্থায় নারীর বিয়ে দিয়ে দিলে, তার যে শারীরিক বিভিন্ন ধরনের জটিলতা হয়, সেগুলো অনেক। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভ হবে, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, বাধাগ্রস্ত প্রসব হতে পারে। বাধাগ্রস্ত প্রসবের জন্য আবার ফিসচুলার আশঙ্কা থাকে। ফিসচুলা হলে প্রস্রাবের গন্ধ গা দিয়ে বের হতে থাকে। অথবা পায়খানার রাস্তায় এটি হলে গা দিয়ে পায়খানার গন্ধ বের হবে। এমন হলে একজন নারীর জীবনে মহা বিপর্যয় চলে আসে।
আরেকটা জিনিস আমরা দেখেছি, একজন নারী ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে গেলে কিন্তু তার পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবে। তার বিয়ে হলেই তাকে বলে যে ‘তুমি গর্ভধারণ করে দেখাও যে বন্ধ্যা নও’। যখন সে গর্ভধারণ করে ফেললো তখন তাকে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নিতে হয়। এর মানে গর্ভবতী হয়ে গেলে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। যখন তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন তার অর্থ উপার্জন করা, নিজের জীবনকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া থাকে না। এর মানে বাল্যবিবাহ একটি নারীর জীবনে কত বড় অভিশাপ নিয়ে আসে, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।
সে নারী বলেই আমাদের কোনো অধিকার নেই বলার, ‘তুমি এই অবস্থার শিকার হও বা তুমি একটি অন্যায়ের শিকার হও’। এটা আমাদের সামাজিকভাবে বুঝতে হবে, বাবা-মাকে বুঝতে হবে।
মা-বাবার হয়তো দুটো সন্তান। ছেলে ও মেয়ে। কিন্তু মেয়েকে বিসর্জনটা বেশি দিতে হবে। এই যে সামাজিকভাবে একটি মেয়ের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা, অবহেলা ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণ- এটি থেকে রুখে দাঁড়াতে হবে। সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
সরকারকে প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ, সরকার আইন করছে। তবে আইনের ব্যবস্থাপনাটাও যেন ভালো হয়, প্রয়োগ ঠিকমতো হয়, সেটি খেয়াল করতে হবে। আমরা যারা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি, এটাও তাদের দায়িত্ব। তারা সোচ্চারে, কাজে, কর্মে, বক্তৃতায়, চর্চায় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বলবে। এই বাল্যবিবাহ দিয়ে একজন নারীর ওপর অন্যায় করা যেতে পারে না। মৃত্যৃর দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক নয়।
সামাজিকভাবে আমাদের কী করা দরকার? যখন আপনি জানতে পারছেন, এই বাড়িতে একটি বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তখন আপনাকে কী করতে হবে? তখন আপনাকে প্রশাসনিক যেসব মানুষ রয়েছে, তাদের খবর দিতে হবে। জানাতে হবে এখানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে। তবে এই ব্যাপারে অবগত সবাই কিন্তু কার্যকারিতাটা আমরা কম দেখি। সুতরাং সবাই মিলে এটি বন্ধ করতে না পারলে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এটা আমাদের নৈতিকভাবে ঠিক নয়। একটা নারীকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে তার উপর অত্যাচার করবো, অগ্রগতিকে বন্ধ করবো, সেটা হবে না। এটা যে একটি অন্যায় এই জ্ঞানটা মানুষের থাকতে হবে। এর জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, স্কুল কলেজের শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। তাদেরও ওই মেয়েটাকে সুরক্ষা দিতে হবে।
আমরা দেখেছি, স্কুলে রচনা প্রতিযোগিতা করলে, সেখানে ছাত্রদের নিয়ে লিখতে বললে, তখনও শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। তো একে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। না হলে, আমরা এই নারীদের পিছিয়েই রাখবো সারাজীবন। আর একটি দেশ কখনো উন্নত হয় না, যখন এর নারী পিছিয়ে থাকে। দেশের অগ্রগতি পিছিয়ে যায়। আমাদের বলতে হবে, ‘আসুন, আমরা সবাই মিলে বাল্যবিবাহকে রোধ করি’। সোচ্চার হই এটি বন্ধে। বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলি।
লেখক:
রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ