ডা. হালিদা হানুম আখতার
আমরা যারা নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, উপলব্ধি করেছি তাকে যে ব্যবস্থাপনা বা সেবা বা উপদেশ দিই না কেন, পারিবারিক জীবনে সহিংসতার শিকার হলে সেগুলো কোনো কাজে আসে না।
কারণ, আমরা অনেক প্রসব করিয়েছি। গবেষণার মাধ্যমেও প্রসব পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখেছি, কোনো মা একটি কন্যাশিশু জন্ম দিলে সেই মাকে অবজ্ঞা, নির্যাতন, বকাঝকার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সাধারণত দেখি, নারী নির্যাতন নিয়ে মানুষ বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। তবে এটি নারীর জীবনের এত বড় একটি সমস্যা যে আলোচনা করতে হবে। আমি যেহেতু গবেষণা করি, জনস্বাস্থ্য ও নারী স্বাস্থ্য অ্যাডভোকেসি করি, আমরা ভালো করে বিচার করলে দেখি, একজন মেয়ে তার জীবনচক্রের, একেবারে জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে যেমন গবেষণা রয়েছে, সারাবিশ্বেও রয়েছে।
এমনও দেখেছি, মায়ের জরায়ুর ভেতরে শুধু ভ্রূণটাই রয়েছে, তখন থেকেই নির্যাতন শুরু হয়েছে। কীভাবে? আমরা সোনোগ্রাফির মাধ্যমে ভ্রূণটি নারী, নাকি পুরুষ– সেটি জানতে পারছি। এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে মেয়ে হবে জানতে পারলেই গর্ভপাত করিয়ে ফেলা হয়। সে জন্ম নেওয়ার আগেই মৃত্যুর শিকার হচ্ছে।
এর পরের ধাপে দেখা যাচ্ছে, অনেক বাড়িতে মেয়ে হলে মন খারাপ করে ফেলছে। এই জিনিসটির ছাপও তার সারাজীবনে পড়ছে। এর পর দেখা যাচ্ছে, মেয়ে হওয়ার জন্য তার মা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মায়ের যত্নের অভাব হয়, তার ওপর বকাঝকা চলতে থাকে।
এরপর শিশু আরেকটু বড় হতে থাকলে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে; সেখানেও দেখা যাচ্ছে, ছেলেসন্তানের জন্য পাউডার দুধ দেওয়া হচ্ছে, জুস দেওয়া হচ্ছে। ধারণা হলো, ছেলেশিশু কীভাবে কেবল মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বাঁচবে! তাই তাকে আগে থেকেই বাড়তি খাবার দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমরা কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে দেখছি, তার খাবারের অভাব হচ্ছে। যেখানে ছয় মাসে তাকে বাড়তি পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার কথা, সেখানে সে মায়ের দুধই খাচ্ছে। গবেষণা করে আমরা বিষয়টি তীব্রভাবে দেখেছি।
আমরা আইসিডিডিআরবি,র গবেষণায়ও দেখেছি, একটি শিশুর ডায়রিয়া হলে আর সেটি ছেলে হলে, অল্প একটু লক্ষণ দেখা দিলে তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে একটি মেয়েশিশুর ডায়রিয়া হলে খুব খারাপ অবস্থা হওয়ার পর টাকা-পয়সা জোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ছয় মাসের বাচ্চার মধ্যেও নারী ও পুরুষের যে বিভেদটা করা হয়, সেটা সহিংসতার মতোই। মানুষের সেবা লাগলে একজন পাচ্ছে, আরেকজন পাচ্ছে না– এটা বিরাট বৈষম্য। তখন বিরাট একটি সহিংসতার শিকার হচ্ছে কন্যাশিশুটি।
এর পরের ধাপে সেই মেয়েটি কিশোরী হচ্ছে। সেখানেও আমরা দেখি যে ওই বাড়ির ছেলেটিকে বেশি প্রোটিন জাতীয় খাবার দেওয়া হচ্ছে। মাংস বা মাছের মাথা খেতে দিচ্ছে। তবে মেয়েশিশুটির বেলায় তেমন হয় না। সে মায়ের সঙ্গে খায়। বাড়ির অন্যান্য পুরুষের সঙ্গে বসে খায় না। সে মায়ের সঙ্গে দেরি করে খাচ্ছে। সব খাবার খাওয়ার পর মায়ের জন্য যে তলানির অংশটুকু রয়েছে, সেটিই সে খাচ্ছে। এখানেও তার পুষ্টির অভাব হচ্ছে। বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলেরও যেমন পুষ্টির প্রয়োজন, একজন মেয়েরও একই খাবার প্রয়োজন। সেখানে মেয়েটি অনেক কম খেয়ে বড় হচ্ছে।
আবার কিশোরী থেকে সে যৌবনে এলে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় আগে। ১৩ বা ১৫ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলে তাড়াতাড়ি মা হতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে তার শরীরের ওপরে দ্বিতীয় চাপ পড়ছে। একে তো সে দুর্বল, খাটো, রক্তস্বল্পতা নিয়ে বড় হচ্ছে; এর মধ্যে তার ওপরে সন্তান হওয়ার এবং বিয়ে করার যে চাহিদা দেওয়া হয়, এটি আমরা মনে করি একটি নির্যাতনের মধ্যে পড়ে।
একটু ভেবে দেখুন, ১৫ বছরের মেয়েটির সঙ্গে তো তার সমবয়সী ছেলের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। একজন বয়স্ক মানুষ, যে আয় করতে পারে, তার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। সেই মানুষটির সঙ্গে তার যে আদান-প্রদান হচ্ছে, সেটিও এক ধরনের নির্যাতনের অবস্থা। আমরা ঠিক এতভাবে বিষয়গুলো কি চিন্তা করি?
আজকের লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যারা গভীরভাবে চিন্তা করি, যারা অ্যাডভোকেসি করতে পারি, তারা যেন এসব বিষয় অনুধাবন করে সচেতন হয়ে কাজটি করি।
মেয়েটির ক্ষেত্রে এর পরের ধাপে এলে সে গর্ভধারণ করল। এরপর তার সেবার যে প্রয়োজনটা, দেখা যাচ্ছে সে ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। তার যে অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না। বাড়ির মানুষ বলছে, ‘আমরা তো এগুলো ছাড়াই বড় হয়েছি। এগুলো ছাড়াই আমরা দশটা বাচ্চা জন্ম দিয়েছি। তোমার আবার মাসে মাসে হাসপাতালে যেতে হবে কেন?’ এভাবে মেয়েটিকে অ্যান্টিনেটাল চেকআপে যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়।
আমরা আরও গবেষণা থেকে দেখেছি, একজন নারী সন্তানসম্ভবা হলে তার ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। গবেষণাই বলছে, তার স্বাভাবিক সময়ে যেই নির্যাতনটা হয়, তা গর্ভাবস্থায় বেড়ে যায়। কারণ, তখন সে আরও দুর্বল থাকে। সংসারের কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। স্বামীকে সে সেই পরিমাণে খুশি করতে পারে না।
গবেষণালব্ধ যে ফলাফলগুলো আমরা পাচ্ছি, তাতে এই বৈষম্যের বিরাট একটি প্রকট চেহারা দেখা যাচ্ছে, যা শঙ্কিত করার মতো। এর পরে প্রসবের সেবার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটির জটিলতা হচ্ছে, রক্তপাত হচ্ছে, ফুল পড়ছে না, তবে তাকে বাড়িতেই রাখা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ নেই, এমন ব্যক্তি দিয়ে সেবা দেওয়া হয়। ফুল হাত দিয়ে খামচি দিয়ে বের করা হচ্ছে।
মা এক ঘণ্টার মধ্যেই শকে মারা যাচ্ছে।
এরপর দেখা গেল, বয়স আরও বাড়ছে, মেনোপজ হলো। মেনোপজের বিষয়ে তারা জানে না। তথ্য নেই। সে সময় যেসব সমস্যা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য কার কাছে যাবে, তাও তারা জানে না। তখন সে ভুগতেই থাকে। বেশি ভুগলে তখন নানা ধরনের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। পরিবারের মানুষ হয়তো বলে, ‘এখন হাঁটতে পারো না, চলতে পারো না। হাতে ব্যথা, পায়ে ব্যথা। সারাক্ষণই মাথা গরম আছে বলতে থাকো।’ তাহলে এসব লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর কিন্তু সে আরেক ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
আরেকটি হলো আরও বয়স বাড়লে সে নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে না। আরেকজন সেবাদানকারী লাগে। তখন আরেক নির্যাতনের শিকার হয় নারীটি। শিশুর মতো তাকেও প্রোটিন জাতীয় খাবার দেওয়া হয় না। হয়তো পান্তাভাত খাচ্ছে। এগুলোও অবহেলা ও নির্যাতন। বাড়ির লোক অপেক্ষা করছে, দু’দিন পর তো সে মরেই যাবে, তাকে আর খাবার দিয়ে কী লাভ!
আমি হয়তো বিষয়গুলো গল্পের মতো বললাম। তবে প্রত্যেক নারী তার জীবনচক্রে এসব নির্যাতনের শিকার হয়। একটি-দুটি ঘটনা নয়, এমন অসংখ্য রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৫ সালের গবেষণা থেকে দেখতে পাই, ৭০ শতাংশ নারী বলছে, সে তার জীবদ্দশায় সঙ্গীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেই নির্যাতনটা শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক হতে পারে। কিশোরীর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ বিবাহিতরা বলছে, ‘আমার সঙ্গীর মাধ্যমে আমি নির্যাতিত হয়েছি।’
আমাদের আসলেই খুব মন দিয়ে চিন্তা করতে হবে, এই যে জীবনচক্রে তারা নির্যাতনের শিকার, এখান থেকে তারা কীভাবে বেরিয়ে আসতে পারে? সমাজের পরিবর্তন আনতে হলে সমাজে যেসব কর্ণধার রয়েছে, তাদের কাছে তথ্যটা নিয়ে যেতে হবে। তাদের বলতে হবে, এই নারীদের নির্যাতনের শিকার অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসুন।
আর একজন নারীকে তার নিজের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। তার যে অধিকার রয়েছে, সেটি তাকে জানতে হবে এবং চাইতে হবে। অধিকার যেন সে পায়, সেটার জন্য যে সংগ্রাম করা প্রয়োজন, সেটি করতে হবে।
আমি শুধু মুখ বুজে মারই খেয়ে গেলাম, নির্যাতন সহ্য করে গেলাম, এটি দিয়ে জীবন শেষ নয়। নির্যাতন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তার জন্য যা করা দরকার, সেগুলো করা প্রয়োজন।
লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।