ডা. হালিদা হানুম আখতার
আজ তামাক সেবন বা ধূমপান নিয়ে আলোচনা করবো। এটি জনস্বাস্থ্যের ওপর কী প্রকোপ ফেলে সেটি থাকবে আলোচনার মূল বিষয়।
আমরা যারা তামাক সেবন বিষয়ে কথা বলি, যারা ডাক্তার বা এর প্রতিরোধের সঙ্গে জড়িত আছি, তারা একে প্রাণঘাতী অভ্যাস বলে মনে করি। তো আজ সেটিই বলবো, কেন একে প্রাণঘাতী বলা হয়? এটি কীভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে চলে যায়।
কেন মৃত্যুটা সময়ের আগে হচ্ছে?
একজন মানুষের মৃত্যুর একটা বয়স বা সময় থাকে। তবে এই ধূমপান বা তামাক সেবনটা একজন মানুষকে মৃত্যুর দিকে একেবারেই ঠেলে দেয়। যেটা প্রি ম্যাচিউর ডেথ বা সময়ের আগেই মৃত্যু।
পৃথিবীর চিত্র
দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে ছয় মিলিয়ন মৃত্যু তামাকের কারণে হয়। এর মধ্যে দুই ধরনের তামাক গ্রহণ রয়েছে। একটি হচ্ছে সরাসরি সেবন বা ধূমপান করা। আরেকটি হলো, পরোক্ষ ধূমপান। আরেকজন খাচ্ছে বা একটি শিশুর বাবা খাচ্ছে, একজন স্ত্রীর স্বামী তার পাশে বসে খাচ্ছে। তখন সেই শিশুটি বা স্ত্রীটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অর্থাৎ যে খাচ্ছে না, কেবল পাশে বসে রয়েছে সে-ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি পরোক্ষ ধূমপান।
দেখা যাচ্ছে, ধূমপানের কারণে ৬০ লাখের মৃত্যু হলে প্রায় ছয় লাখের মতো মারা যাচ্ছে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে। তাহলে এর প্রভাবটি সরাসরি ও পরোক্ষ দুটোভাবেই পড়ছে।
প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে তামাক সেবনের কারণে। এটা যেন চিন্তারও বাইরে। এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা। আবার প্রতি ১০জন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির একজন তামাক সেবনের কারণে মারা যায়। ১০টি মৃত্যু ভিন্ন ভিন্ন কারণে হয়ে থাকলে অন্তত একটি মানুষ মারা যাচ্ছে তামাক সেবনের কারণে। তাহলে এটি রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আরো দেখা যাচ্ছে, যতজন ধূমপান করে তার অর্ধেক এই কারণটির জন্যই মারা যায়। ইংরেজিতে বলা হয়, Tobacco kills half of its users। এর মানে বোঝাই যাচ্ছে যে এটি মানুষের কত বড় প্রাণঘাতী অভ্যাস।
এটা দিয়ে কিন্তু পেট ভরে না। মানুষ মনে করে ধূমপান করলে মন ভালো হয় বা মনোযোগ আসে। এই যে একটি বাজে চিন্তা এবং এই চিন্তার জন্য আমরা যেই অভ্যাসটা করে রাখি, এটা প্রাণঘাতী অভ্যাস।
তামাক গ্রহণের এই অভ্যাস অনুন্নত ও উন্নতিকামী দেশে ৮০ শতাংশ। এর মানে যেসব দেশ গরিব বা গরিবের পর্যায়ে, এসব দেশের তামাক গ্রহণের চর্চা বেশি এবং তামাকের কারণে হওয়া মৃত্যুও বেশি।
মৃত্যুর অনেক কারণ রয়েছে। রোগ হলে তো সেবা লাগে। আর্থিক স্বচ্ছলতা লাগে। আমার ক্যানসার হলে এবং পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে আমি সেবা পাবো না। তাহলে তো মৃত্যু এগিয়ে আসবেই। সেই জন্য এসব বিষয় আমাদের ভালো করে জানতে হবে।
বাংলাদেশের চিত্র
বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ৩৫.৩ শতাংশের বেশি তামাক ব্যবহার করে। সিগারেট পান, গুল খাওয়া, বিড়ি গ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে তামাক গ্রহণ করা হয়। ১০০ জনের মধ্যে ৩৫ জন করে। এই ৩৫ জনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে অর্ধেকের একটু কম পুরুষ, আর ২৫ শতাংশ নারী। সুতরাং নারীও এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তারা হয়তো সবসময় ধূমপান করে না। তবে গুল খায়। সারারাত মুখের মধ্যে গুল রেখে হয়তো ঘুমিয়ে গেলো। সেখান হয়তো ক্যানসার হলো। এতে দেখা যায়, মুখের ঐ নির্দিষ্ট অংশটিই কেটে ফেলতে হচ্ছে।
অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৩ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত, এদের মধ্যে সাত শতাংশ ধূমপান করে। এর মধ্যে আবার নারী-পুরুষের ভেদাভেদ রয়েছে। পুরুষ চার শতাংশ, নারী এক শতাংশ। তবে নারী রয়েছে।
আবার দেখা যাচ্ছে, দুই দলের মধ্যেই সাড়ে চার শতাংশ মানুষ ধোঁয়া ছাড়া তামাক গ্রহণ করছে। তারা হয়তো মনে করছে ধোঁয়া না থাকলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যেও তামাক সংক্রান্ত রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
প্রশ্ন থাকতে পারে, মৃত্যুর ঝুঁকি কেন হচ্ছে ? সেই ক্ষেত্রে বলতে চাই, তামাক গ্রহণে ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। যেহেতু ধোঁয়াটা ফুসফুসের ভেতর যায়, তাই এই অঙ্গটির যত ধরনের রোগ রয়েছে, সব বাড়িয়ে দেয়। অ্যাজমা হলে এর অ্যাটাক বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধূমপান করা হলে ফুসফুসের ভেতর যে ছোট ছোট নল বা ছিদ্র থাকে, যেটা দিয়ে বাতাস আসা-যাওয়া করে, সেগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া তামাক গ্রহণ টাইপ-২ ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়ায়। দেহে সংক্রমণ ও প্রদাহ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। সুতারং দেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকে তামাক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই, তামাক গ্রহণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাসকে আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বন্ধ করতে হবে।
লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ