ডা. হালিদা হানুম আখতার
আমরা একটা কথা ইংরেজিতে খুব শুনে থাকি। সেটি হলো, Tobacco kills half of its users। এর মানে তামাক এমন একটি জিনিস, যা এর ব্যবহারকারীর অর্ধেককে মেরে ফেলে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই কথা বলা হচ্ছে? আজ আমরা সেটিই আলোচনা করবো, তামাক এতো প্রাণঘাতী কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ডাটা দেখলে দেখা যাবে, পাঁচ জনের মধ্যে একজন মারা যাচ্ছে ধূমপানের কারণে। একটি কথা আমরা বলি, সেটি হলো, তামাক প্রায় দেহের প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যক্তির রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। দেহের সব অঙ্গে যত রকম রোগ হয়ে থাকে, প্রায় সবকটির প্রকোপ সে বাড়ায়।
ফুসফুসের রোগ বাড়ায়
প্রথমেই জানাতে চাই, ধূমপান ফুসফুসের কী ক্ষতি করে? প্রায় ৯০ শতাংশ ধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার হয়। এই ক্যানসারে প্রতি বছর পুরুষের তুলনায় আবার নারী বেশি মারা যাচ্ছে। অনুন্নত দেশে তামাক সেবন বেশি। অনুন্নত দেশে ফুসফুসের ক্যানসার, একই কারণে বেশি। সুতরাং এই ক্যানসার একটি বড় বিষয়।
আরেকটি হলো, সিওপিডি। ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। ৮০ শতাংশ ধূমপায়ীদের মধ্যে রোগটি হচ্ছে। সিওপিডি ফুসফুসের কষ্টের একটি বিষয়। এই রোগ নারী ও পুরুষ উভয়েরই হয়। এতে ফুসফুসের যে নালী রয়েছে বা অ্যালভিওলাই রয়েছে- যেখানে বাতাস যাওয়া-আসা করে- সেগুলোর লেয়ার নষ্ট হয়ে যায় বা সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এতে অঙ্গটির কাজ ভালোভাবে হয় না। ফুসফুসের মধ্যে সমস্যা হয়ে যায়।
হার্টের রোগ বাড়ায়
ধূমপান হার্টের রোগকে বাড়িয়ে দেয়। যারা তামাক সেবন করে, তাদের করোনারি হার্ট ডিজিজ দুই থেকে চারগুণ বেশি হয়।
স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়
স্ট্রোকের বিষয়টিও ঘটে তামাক গ্রহণের কারণে। যারা ধূমপায়ী তাদের মধ্যে দুই থেকে চারগুণ বেশি স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে।
অ্যাজমা অ্যাটাক বাড়ায়
অন্যদিকে যাদের অ্যাজমা অ্যাটাকের সমস্যা রয়েছে, তামাক গ্রহণ তাদের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি আরো বাড়ায়। ধূমপানের কারণে অ্যাজমা অ্যাটাক ঘন ঘন হতে পারে, রোগমুক্তির সম্ভাবনা কমতে পারে।
হাড়ের রোগ বাড়ায়
এ ছাড়া তামাক গ্রহণ আমাদের হাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হাড়কে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। অস্টিওপরোসিস বাড়াচ্ছে। মেনোপজের পরে নারীর মধ্যে এই সমস্যা এমনিতেই বেশি দেখা যায়। এর ওপর সে তামাক ব্যবহার করলে, এর ঝুঁকি বাড়ে।
দাঁতের রোগ বাড়ায়
তামাক দাঁতের ক্ষতি করে। দাঁত আলগা করে দিচ্ছে। মাড়ির স্বাস্থ্যকে নষ্ট করছে। মুখে গন্ধ হচ্ছে। সুতরাং তামাক গ্রহণ দাঁতের স্বাস্থ্যকেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেখা যাচ্ছে, যারা ধূমপান করে তাদের দাঁত দ্রুত পড়ে যাচ্ছে।
চোখের রোগ বাড়ায়
তামাক গ্রহণ চোখেরও ক্ষতি করে। একটা বয়সের পড়ে চােখে ছানি হয়। তবে দেখা যাচ্ছে, যারা ধূমপায়ী তাদের ছানি বয়সের আগেই হচ্ছে। এর মানে ধূমপান চোখের ছানির সমস্যা বাড়াচ্ছে।
অপরদিকে, চোখের মধ্যে আরেকটি বিষয় হয়। সেটি হলো ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন। এর কারণে বেশি বয়সের আগেই অন্ধত্ব বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস বাড়ায়
আমরা জানি, ডায়াবেটিসের প্রকোপ বর্তমানে খুবই বেড়েছে। যারা ধূমপায়ী, তাদের এই সমস্যাটি বেশি হয়।
দেহের সংক্রমণ বাড়ায়
তামাক গ্রহণকারীদের সারা দেহে সংক্রমণ বা প্রদাহ বেশি হয়। তাদের সংক্রমণ হলে, সারতে সময় লাগে। প্রদাহ হলেও সহজে ভালো হতে চায় না। এতে ভোগান্তি বেড়ে যায়। চিকিৎসার খরচ বাড়ে।
ত্বক ও চুলে ক্ষতি বাড়ায়
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক গ্রহণকারী ব্যক্তিরা কানে কম শোনে। অনেকের চুল পড়ে যায়। অনেকের আবার চামড়ায় সংক্রমণ হয়। সুতরাং ধূমপানের কারণে কয়েকভাবেই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধূমপানের কারণে রোগের ঝুঁকি বাড়ে এবং রোগ নিরাময় হতেও দেরি হয়।
বন্ধ্যত্বের ঝুঁকি বাড়ায়
এ ছাড়া ধূমপান নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। দেখা যাচ্ছে, নারীর জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে। নারী ওভারি ক্যানসারের ঝুঁকিতে পড়ছে। ওভারির কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সন্তান হচ্ছে না।
আরেকটি বিষয় আমরা দেখতে পাই বন্ধ্যত্ব। এটি নারীর কারণে হচ্ছে। তার ওভারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এমন হয়। আবার পুরুষের কারণেও হচ্ছে। পুরুষের স্পার্ম অকেজো হয়ে যাচ্ছে, সময়ের আগে। স্পার্মের আকৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর গুণগত মান ঠিক থাকছে না। তাই পুরুষ ও নারীর উভয়ের কারণেই বন্ধ্যত্ব হচ্ছে। এ ছাড়া তামাক গ্রহণের কারণে দেহের হাত ও পায়ের যে সমন্বয় সেটি কমে যায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তামাক দেহের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধূমপান সম্পূর্ণ দেহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এটি খুব শঙ্কার বিষয়।
আর রোগ হলেই তো আপনাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। টাকা খরচের প্রয়োজন পড়বে। সবাই তো আর অত ধনী বা বড়লোক নয়, যে সেবা নিতে পারবে। তখন সেবা না নিতে পারলে তার মৃত্যু আরো এগিয়ে আসবে। সুতরাং দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাঁচতে চাইলে তামাক গ্রহণ একদমই বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে অনেকটাই সুস্থভাবে বাঁচা সম্ভব।
লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ