ডা. হালিদা হানুম আখতার
একটা ব্যাপার আমরা সবসময়ই শুনে থাকি, বিশেষ করে যারা গুরুজন, বয়স্ক বা প্রবীণ তাদের কাছ থেকে। তারা অনেক সময় বলেন, ‘চশমাটা কোথায় রাখছি, ভুলে যাচ্ছি।’ ‘চাবিটা কোথায় রাখলাম, মনে পড়ছে না।’
এই যে ভুলে যাওয়া, এর সম্পর্কে একটা ধারণা হলো, বুড়ো হলেই সবাই ভুলে যায় বা বয়স হলেই ভুলে যায়। আসলে তা নয়। একে একটা রোগ বলে নির্ণয় করা হয়েছে।
আলঝাইমার নামে একজন বিজ্ঞানী, যিনি পোস্টমর্টেম করে দেখেছেন ব্রেইনের মধ্যে এক জায়গায় ডেমেজ বা ক্ষয় হচ্ছে। এবং তার আশেপাশের জায়গায় যে স্নায়ুগুলো রয়েছে তা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন সেই রোগটি নির্ণয় করে তার নামে করা হয়েছিল। তাই এই রোগটির নাম আলঝাইমার।
আলঝাইমার একটি রোগের নাম। তবে সার্বিকভাবে আরেকটি রোগের নাম হলো, ডিমেনসিয়া। প্রশ্ন করতে পারেন, এটি নিয়ে আমি কেন কথা বলছি, আমি তো নারী স্বাস্থ্যের মানুষ? কারণ, সারা পৃথিবীতে যত ডিমেনসিয়া রোগী রয়েছে, এর চারজনের মধ্যে তিনজনই নারী। সুতরাং এটি নারীর ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা ফেলে। তাই এটি নিয়ে আমাদের সবারই জানা প্রয়োজন।
এই কারণেই ডিমেনসিয়া নিয়ে আজ কথা বলবো। ডিমেনসিয়া কী, কেন হয়, একজন মানুষকে কীভাবে এটি বিব্ধস্ত করে- এসব থাকবে আলোচনায়। আবার এটি নিয়ে আলোচনার আরেকটি কারণ হলো, আমাদের সমাজেও বিষয়টি নিয়ে জ্ঞান অনেক কম। পরিবারের মানুষ তো জানেই না, শহরে কিছু জানলেও গ্রামের মানুষ আরো কম জানে। যারা সেবাকর্মী রয়েছেন, একেবারে চিকিৎসক থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ের সহযোগী, তাদের মধ্যেও এই রোগটি সম্পর্কে জ্ঞান কম।
তবে আমরা আজ কী দেখছি? সারা পৃথিবীতে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন ডিমেনসিয়া রোগীর উৎপত্তি হচ্ছে। এর মানে এটি একটি বিরাট সংক্রমণের মতো অবস্থায় রয়েছে। তাই এর বিষয়ে আমাদের ভীষণভাবে জানা দরকার।
এটি এমন একটি রোগ যে মস্তিষ্কের কিছু অংশ ডেমেজ বা ক্ষয় হয়ে যায়। এতে হয় কী, যেই জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেখানকার কাজ মস্তিষ্ক আর করতে পারে না। তখন একটি মানুষের মধ্যে কী হয়? তার স্মৃতি কমে যাচ্ছে, সে কোনো জিনিসের নাম মনে করতে পারছে না, সময় ভুলে যাচ্ছে ইত্যাদি। পরিবারের মানুষ মনে করে বয়স হয়েছে, এখন তো ভুলে যাবেই। সুতরাং এটাকে তারা খুব স্বাভাবিক মনে করে।
তবে এটি এমন একটি রোগ, যা এমনিতে ভালো হয় না। যত দিন যাবে এটি আরো জটিল হয়ে উঠবে। রোগটি বাড়তে থাকে। রোগের উপসর্গগুলো বাড়ে। সে কী করবে, কোথায় যাবে, বুঝতে পারে না। অনেক ধরনের উপসর্গ রয়েছে, আমরা জানি না তাই বুঝতে পারি না, এই রোগের ক্ষেত্রে কী করতে হবে।
এর ঝুঁকিগুলো কী? যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে, ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, ডায়াবেটিস রয়েছে, বা পরিবারে কারো এ ধরনের রোগ রয়েছে তাদের এমন হতে পারে। অনেকের ধারণা, কেউ বড় বড় অ্যানেসথেসিয়া বা অপারেশনের মধ্য দিয়ে গেলেও এই রোগ হতে পারে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক অবস্থায় রোগীর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এই জন্য তার ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে। দিন দিন এটি যেহেতু একটি ক্ষতিকর অবস্থায় চলে আসছে, তাই এই মানুষটির জন্য আলাদাভাবে সেবা দরকার। আলাদা মনোযোগ প্রয়োজন। তার কী কী বা কত ধরনের সমস্যা হতে পারে, এসব বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের জ্ঞান না থাকলে, তারা এই মানুষকে নির্যাতন করা শুরু করে।
অনেক সময় দেখা যায়, ডিমেনসিয়া আক্রান্ত রোগী খাবার খেতে পারছে না। কীভাবে লোকমা তুলে খেতে হয় বুঝছে না। অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা কাজের জন্য যে সীদ্ধান্ত নেওয়া, সেটা করতে অক্ষম হয়। শিশু জন্মের পর কী হয়? যখন বড় হয়, একটু করে কাজ শিখে, একটু করে কথা বলে। তবে ডিমেনসিয়ার রোগীর ক্ষেত্রে এটা উল্টো দিকে যায়। ব্যক্তি আগে সব পারতো। তবে ধীরে ধীরে সেই পারার ক্ষমতা হারাতে হচ্ছে। একটা সময় সে হয়তো নিজে কী চাচ্ছে বলতে পারে না। তাই পরিবারের জানা দরকার, এটি একটি রোগ।
সবার কিন্ত এই রোগ হয় না। একটি পরিবারে হয়তো পাঁচজন রয়েছে, সবারই হয় এমন নয়। দেখা যাবে, একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অথবা চারটি পরিবারের মধ্যে হয়তো একজনের হলো। প্রতি সেকেন্ডে একজন করে এই রোগ হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে সাড়ে পাঁচ কোটি এই রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ১১ লাখের মতো মানুষ ডিমেনসিয়াতে ভুগছে। সতুরাং, এটি বাড়তে থাকবে।
একটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের এখন আয়ুষ্কাল বেড়ে গেছে। আর নারীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পুরুষের তুলনায় আড়াই থেকে তিন বছর বেশি বাঁচছে। বয়স বাড়ার পর তারা আরো বেশি দিন বাঁচছে। তাই দেখা যায়, এই রোগটি তাদের মধ্যে বেশি হয়।
আমার বলার উদ্দেশ্য হলো, এই ডিমেনসিয়াকে একটি বয়সের ব্যাপার ভেবে অবহেলা না করে, রোগীর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তার পরিচর্যার জন্য যা যা করা দরকার সেই বিষয়ে সহযোগিতা করা জরুরি। পাশাপাশি সময় দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, এই ধরনের সমস্যা বাড়িতে কারো হলে মানুষ লুকিয়ে রাখে। কারণ, সমাজে একটি কুসংস্কার বা স্টিগমা রয়েছে যে ‘ওই মানুষটি পাগল’। তবে সে তো পাগল নয়। সে একজন অসুস্থ মানুষ। তার মস্তিষ্কে সমস্যার জন্য এই অসুস্থতা হয়েছে। মানুষটি যে পাগল নয়, এই তথ্যটি সবার কাছে দিতে হবে।
হার্টের সমস্যা হলে তো আমরা পাগল বলি না। হার্টে তখন আলাদা করে সেবা দেওয়া হয়। তেমনিভাবে মস্তিষ্কের সমস্যা হলেই যে সে পাগল হয়ে গেলো, তা কিন্তু নয়।
সুতরাং এই বিষয়টি আমাদের সবাইকে বুঝাতে হবে। এই মানুষটিকে আলাদা করে সেবা ও পরিচর্যা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জানা জরুরি।
রোগীদের মধ্যে কেউ হয়তো একেবারে চুপ করে যেতে পারে, কেউ আবার বাইরে বের হয়ে যেতে পারে। পুরোনো স্মৃতি হয়তো তার বেশি মনে থাকে। নতুন যে ঘটনা ঘটছে সেটি হয়তো ভুলে যাচ্ছে। আজ সকাল না কি বিকাল, ঢাকায় রয়েছে না কি রংপুরে রয়েছে- এই যে সময় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার জ্ঞান, এটি ধীরে ধীরে কমছে।
মোদ্দা কথা হলো, ডিমেনসিয়া কোনো বয়সের বিষয় নয়। তবে বয়স হলে এটি বাড়তে পারে। এই ধরনের ব্যক্তির যে পরিচর্যা দরকার এটি যেন পরিবারের মানুষ বোঝে, সমাজের মানুষ বোঝে। সেইভাবে যেন তাকে সম্মান দেয় এবং তার সেবাটা যেন করতে পারে। এসব বিষয়ে সচেতন হওয়াটা ভীষণ জরুরি। তাহলেই এসব রোগীর পক্ষে অনেকটা সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব।
লেখক: রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
