মাহবুব শওকত
বিশিষ্ট নারী স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডা. হালিদা হানুম আখতার তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে দেশে ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন।
সম্প্রতি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘রোকেয়া পদক’ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক ‘সাম্মানিক ফেলোশিপ’ লাভ করেন।
২০২১ সাল থেকে ডা. হালিদা হানুম ব্রেস্ট ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস ফোরাম-এর সারথি হিসেবে রয়েছেন। তাঁর সংগঠন ‘ সোসাইটি ফর হেলথ প্রমোশন লিঙ্ক’ ব্রেস্ট ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস ফোরমের অন্যতম সদস্য সংগঠন।
ডা. হালিদা হানুম আখতার জন্মেছেন রংপুরে। তাঁর মা ডা. হুমায়রা খানম গাইনোকলজিস্ট ছিলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হওয়ার আগে থেকে। জীবনসঙ্গী (স্বামী) ইঞ্জিনিয়ার গোলাম ফরিদুদ্দিন আখতার। বুয়েট ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। দুই কন্যা- ফারহানা আক্তার রুহী, আফসানা আক্তার। তারা উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত এবং প্রবাসী।

ডা. হালিদা রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর ১৯৬৯ সালে তিনি পরিবার পরিকল্পনা মোবাইল টিমের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু হয় মাতৃমৃত্যু কমানো ও নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের লড়াই। কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে আমেরিকায় পাঠানো হয়। তিনিসহ মোট তিনজনকে তখন বাংলাদেশ থেকে এই প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকায় পৌঁছার পর সেখানে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কোর্স করার ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। এগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা দ্বারা ধর্ষণের শিকার সন্তানসম্ভবা মেয়েদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি উদ্যোগ নেয়। যার নাম ‘সেবা সদন’। এই সদনে কাজ করার দায়িত্ব পড়ে ডা. হালিদা হানুমের ওপর। সেই দায়িত্ব হাসিমুখে সাদরে পালন করেছিলেন তিনি। একাত্তরে বিদেশে অবস্থান করায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপটা এই কাজের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও কমাতে চেয়েছিলেন ডা. হালিদা হানুম আখতার। সেবা সদনে আসা নির্যাতিত নারীদের অপমানে কুঁকড়ে যাওয়া মুখগুলো আজো ব্যথিত করে তাকে।
ডা. হালিদা হানুম আখতারের জন্মনিয়ন্ত্রণ, ব্রেস্টফিডিং, মাতৃমৃত্যু ও অসুস্থতা, গর্ভপাত এবং কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর গবেষণা কার্যক্রম দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের শীর্ষস্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বহু পুরস্কার, সম্মাননায় ভূষিত করা হয় তাকে।
ডা. হালিদা হানুম আখতার বিশিষ্ট প্রজনন স্বাস্থ্য এপিডেমিওলজিস্ট। প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে ৩০ বছরেরও বেশি আন্তর্জাতিক কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একজন ওবি/জিওয়াইএন হিসাবে তার ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণের পর, ড. হালিদা হানুম আখতার জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি থেকে জনস্বাস্থ্যে ডক্টরেট লাভ করেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে তার নেতৃত্বের ভূমিকার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় প্রজনন স্বাস্থ্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BIRPERHT) এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার (FPAB) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং একটি তৃণমূল স্তরের সংস্থা তৈরি করেছেন, যা নারীদের মাতৃত্ব বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়। তার গবেষণার মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে গর্ভনিরোধক কার্যকারিতা, প্রজনন স্বাস্থ্য চাহিদা ও পরিষেবা, গর্ভপাত ও মাতৃত্বকালীন অসুস্থতা ও মৃত্যুহার।
নারী প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ‘জনস হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’- এর ইন্টারন্যাশনাল হেলথ ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ড. হালিদা ছিলেন ইউএসএআইডি-ডিএফআইডির এনজিও স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের প্রধান। কাজ করেছেন পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল এর সিনিয়র কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে। গর্ভবতী নারীদের জন্য গর্ভকালীন সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে ‘মাটির ব্যাংক’ ডা. হালিদার চিন্তাপ্রসূত। বাংলাদেশে সূর্যের হাসি স্বাস্থ্যসেবায় তার ভূমিকা অনন্য।

ডা. হালিদা হানুম আখতার আরো যেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন-
★ ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফপিএবি) ঢাকা, বাংলাদেশ মহাপরিচালক, ২০০৫ থেকে ২০০৮।
★ জনসংখ্যা ও উন্নয়নে অংশীদার (PPD), অংশীদার সচিবালয় ঢাকা, বাংলাদেশ সিনিয়র প্রজনন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।
★ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ ফর প্রমোশন অব এসেনশিয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড টেকনোলজি, বিআইআরপিএইচটি ঢাকা, বাংলাদেশ- এর পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা।
★ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯-এ প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনার জন্য গ্লোবাল টেকনিক্যাল লিড হিসাবে CHS-এ যোগদান করেন।
★ এমসিএইচ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেশন সেল ঢাকা, বাংলাদেশ প্রকল্প পরিচালক, ইত্যাদি।
এ ছাড়াও, প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতায় ডা. হালিদা হানুম আখতার বিভিন্ন বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন।
★ ড. পি.এইচ., জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৮১, জনসংখ্যার গতিবিদ্যা বিভাগ। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি দ্বারা প্রদত্ত বৃত্তি।
★ এম. পি. এইচ, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭৯। দ্য পাথফাইন্ডার ফান্ড, বোস্টন থেকে বৃত্তি পুরস্কার।
★ ই.আই.এস. অফিসার সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল (সিডিসি), আটলান্টা, জর্জিয়া, ইউএসএ, প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগে, জুলাই ১৯৮১ থেকে জুন ১৯৮৩। দুই বছরের জন্য রকফেলার ফেলোশিপ প্রদান করা হয় তাকে।
ডা. হালিদা হানুম আখতার বিগত ৩০ বছর ধরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সোসাইটি ফর গ্রামীণ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের কমিউনিটি ম্যাটারনিটি প্র্যাকটিশনার হিসেবে প্রশিক্ষণ দানে অসামান্য অবদান রেখেছেন। চিকিৎসা ও কল্যাণকর কাজে অবদান রাখায় তিনি ২০২২ সালে জি-১০০ আজীবন সম্মাননা পান। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের জনসংখ্যা পুরস্কারে ভূষিত হন। জনসংখ্যা এবং ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে অসামান্য কাজের জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। জনসংখ্যার প্রশ্নে সচেতনতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ড. হালিদা হানুম আখতার ব্যক্তিবিভাগে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
৭ ডিসেম্বর ২০০৩-এ ডায়রিয়া রোগ ও পুষ্টি বিষয়ক ১০ম এশীয় সম্মেলনে বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের জন্য হোস্ট কান্ট্রি পুরস্কার প্রাপ্ত হন। গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক অ্যালামনাস অ্যাওয়ার্ড পান ১৯৯৭ সালে, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, সোসাইটি অফ অ্যালামনাই, বাল্টিমোর, এমডি, ইউএসএ। জার্মানির জাস্টাস-লিবিগ ইউনিভার্সিটি গিয়েসেন থেকে উন্নয়নশীল দেশ পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে। পরিবার পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহ, জীবনব্যাপী গবেষণা, পরিবারে মাঠ কর্মীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক কাজের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ডা. হালিদাকে।
লেখক
সমন্বয়কারী, ব্রেস্ট ক্যান্সার এওয়ারনেস ফোরাম
এবং
সেক্রেটারি, কমিউনিটি অনকোলজি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ