Wednesday, December 11, 2024
spot_img
Homeঅন্যান্যহবু বাবার ৫ জরুরি দায়িত্ব

হবু বাবার ৫ জরুরি দায়িত্ব

ডা. হালিদা হানুম আখতার

একজন মা সন্তানসম্ভবা হলে, সেটা কেবল মায়েরই আনন্দ নয়, দম্পতির আনন্দ। দম্পতির মধ্যে কে ? ওই নারী, যিনি সন্তানসম্ভবা হয়েছেন এবং সঙ্গে তার স্বামী, যে কি না বাবা বা হবু বাবা। আজ আলোচনার বিষয়ই হলো, এই হবু বাবার কী দায়িত্ব ? এটি নিয়েই বেশ করে আলোচনা করতে চাই।

আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থায়, গ্রামে ও শহরে- দুই জায়গাতেই দেখা যায়, শাশুড়ি বা যিনি বাড়ির বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তি- নারী, তিনি এই বিষয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন। তিনিই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ওই নারীর প্রসব বাড়িতে হবে, না কি হাসপাতালে হবে ? কয়টি অ্যান্টিনেটাল চেকআপে যাবে বা প্রসবের পরিকল্পনা কী ধরনের হবে? তবে আমি বিশেষভাবে এই আলোচনায় যেটাকে গুরুত্ব দিতে চাই, সেটি হলো, ওই সন্তানটির যিনি বাবা, তার কী দায়িত্ব? পুরুষে কী দায়িত্ব ?

সন্তানসম্ভবা মাকে ক্লিনিকে নিয়ে চেকআপ

প্রথমত, হবু বাবা তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ক্লিনিকে চেকআপ করাতে যাবে। ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসকের কাছে আলোচনা করবে। অ্যান্টিনেটাল চেকআপে স্ত্রী ও গর্ভের সন্তানের সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। তাকে জানতে হবে, বাচ্চাটা গর্ভে ঠিকমতো বড় হচ্ছে কি না, মায়ের কোনো জটিলতা রয়েছে কি না, মায়ের রক্ত ঠিক রয়েছে কি না, মা কি রক্তশূন্যতায় ভুগছে, মায়ের রক্তচাপ ঠিকঠাক রয়েছে কি না, মায়ের ওজন ঠিক রয়েছে কি না। সুতরাং বাবার একটি বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তবে আমরা তাদের সাধারণত দৃশ্যের বাইরে রেখে দিই। আমি বলবো, ‘না’, দৃশ্যের ভেতরে রাখতে হবে এবং তাকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।

টাকা জোগাড়

পুরুষের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে এই ক্ষেত্রে। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকাটা তার হাত দিয়ে আসে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।তাই প্রসবের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে, সেটি তাকে আগে থেকেই জোগাড় করতে হবে।

জটিলতার বিষয়ে জানা

জটিলতার বিষয়গুলো তাকে জানতে হবে। কী জটিলতা হচ্ছে? যেমন, ব্লিডিং হয়ে মা মারা যেতে পারে। হেমোরেজ হয়ে মায়ের মৃত্যু ঘটতে পারে। মায়ের ভালোভাবে চেকআপ না হলে, দেখা যাবে রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। তার প্রসাবের মধ্যে অ্যালবুমিন চলে আসছে। সে চোখে অন্ধকার দেখছে। এই জটিলতার কারণে সে পরবর্তী সময়ে খিঁচুনি হয়ে মারা যেতে পারে। মায়ের আগের কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, হার্টের কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, তার ডায়াবেটিস রয়েছে কি না- চেকআপের মধ্যে জানতে পারা যাবে।

ওই বাবার দায়িত্ব থাকবে, তার স্ত্রীকে সঙ্গে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে চেকআপ করে নিশ্চিত হওয়া যে সবকিছু ঠিকমতো চলছে। আর কোনো সমস্যা থাকলে, দ্রুত সেবা নিতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে এবং এখানে কোনো গাফিলতির জায়গা নেই। এখানে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কেউ যতই সহযোগিতা করুক, সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিতে হবে সন্তানের বাবাকে।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া

আমরা দেখছি, এখনো ৫০ শতাংশ প্রসব গ্রামে হচ্ছে এবং বাড়িতে হচ্ছে। এর মানে কী ? সেখানে সেবাদানকারীর অভাব, ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য যে টাকা লাগবে, সেটার হয়তো অভাব রয়েছে। আবার জটিলতা হলে, হাসপাতালে নিতে চায় না, বাড়িতেই রেখে দেয়; এতে মায়ের মৃত্যু হয়, শিশুর মৃত্যু হয়। গবেষণায়, আমরা দেখেছি, ১৯ শতাংশ মা মারা যাচ্ছে, রাস্তায়। মানে হাসপাতালে এতো দেরি করে নেওয়া হচ্ছে, যে রাস্তাতেই বা সেখানে পৌঁছেই মা মারা যাচ্ছে।

চিকিৎসক এসে হয়তো দেখে বলছে, ‘মরা রোগী নিয়ে আসছেন।’ সুতরাং হাপাতালে নিতে হলেও আমাদের সময়মতো নিতে হবে। একটুখানি জটিলতা দেখা দিলেও হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। এই দায়িত্বগুলো থেকে কোনো বাবা পার পাবে না বা পরিবারের কোনো ব্যক্তির পার পাওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে তদন্ত হয়; কার গাফিলতির জন্য হয়েছে, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের দেশে এখনো সেরকম কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তবে আমার মনে হয়, হওয়া দরকার। একটু বেশিই দরকার। কারণ, একজন মা ও একটি শিশুর জীবন -দুটোই অনেক মূল্যবান এবং এটাকে সামনে রেখেই আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে।

রক্তদাতা প্রস্তুত রাখা

একজন মায়ের রক্তের প্রয়োজন হলে, সেটি কে দেবে, আগে থেকে নিশ্চিত হয়ে রক্তদাতাকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এসব প্রস্তুতি ভীষণভাবে দরকার।

আমি সূর্যের হাসি প্রকল্প পরিচালনা করবার সময় ‘তিনদিনের পাহারা’ বলে একটি কাজ আমি করেছিলাম, সেটি হলো, তিনদিনের পাহারা। আমরা জানি, মাতৃমৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় প্রসবের তিনদিনের মধ্যে। আবার শিশু মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়, জন্মের সাতদিনের মধ্যে এবং প্রথম চারদিন বেশিরভাগ মৃত্যুগুলো হয়। এই তিন থেকে চারদিনের মধ্যে আমরা খুব ভালোভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে পারলে বা পাহারা দিতে পারলে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবো এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে পারবো। আমি তখন চারজনের একটি কমিটি করে দিয়েছিলাম। একে তিনদিনের পাহারা বলতাম। এরা সবাই মিলে পরিবারের অর্থ না থাকলে একটুখানি টাকা দিয়ে হলেও, মাকে হাসপাতালে নেওয়া এবং মায়ের যেন সঠিকভাবে প্রসব হয়, এটি নিশ্চিত করতো।

তাে মোদ্দা কথা হলো, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবারের পুরুষ সদস্য, ওই হবু সন্তানের বাবার বিরাট বড় দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্ব না নিলে, পরে যেই ক্ষতিটা হবে, সেটা অপূরণীয়। মায়ের মৃত্যু হতে পারে, শিশুর মৃত্যু হতে পারে। সে জন্য এই বিষয়ে সবাইকে সাবধান থাকার জন্য আমার বিশেষভাবে অনুরোধ থাকলো। এই প্রস্তুতি আমাদের আগে থেকে নিতে হবে, তাহলে মাকে আমরা সুস্থ পাবাে। মা একটি ফুটফুটে সুন্দর শিশুকে নিয়ে সংসার চালাতে পারবে।

ডা. হালিদা হানুম আখতার
ডা. হালিদা হানুম আখতার

লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments