Wednesday, December 11, 2024
spot_img
Homeমন জানালাভালো লাগা— মন্দ লাগাসমস্যা সমাধানে কৌশলী ৭ ধাপ

সমস্যা সমাধানে কৌশলী ৭ ধাপ

ফারজানা ফাতেমা রুমী

কথায় আছে, ‘সকল তালা খোলার জন্যই নির্দিষ্ট একটি চাবি থাকে।’ ঠিক তেমন সকল সমস্যার মাঝেই সমাধান লুকিয়ে থাকে। তবে আমরা কি সব সময় সেই সমাধানটি খুঁজে পাই?

সমাধানের পথ খোঁজার আগে আসুন জানি, সমস্যা কী- এ বিষয়ে।  একটি সমস্যা হলো এমন পরিস্থিতি যা আমাদের কোনো কিছু অর্জন করা থেকে বাধা দেয়। সমস্যা হলে অবশ্যই এটি সমাধানের উপায় বা ‘সমাধান’ খুঁজে বের করতে হয়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই। জীবনের সাধারণ সমস্যা বা সংকট হলো- সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, আঘাত, অসুস্থতা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সন্তান লালন-পালনে সমস্যা, শোক, মৃত্যু, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, শারীরিক অক্ষমতা, দু:খ, ক্ষতি ও আত্মসম্মান সম্পর্কিত সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে জীবনযাপন করা বা এমনকি অজানা ভবিষ্যতের সঙ্গে সমন্বয় করে চলা। সাধারণত মানুষ যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাদের ভেতর তিনটি কাজ করার প্রবণতা থাকে। যথা:
১। ভয় পায় বা অস্বস্তি বোধ করে এবং আশায় থাকে যে এটি নিজে নিজে দ্রুত দূর হয়ে যাবে।
২। মনে করে যে তাদের একটি সমাধান বের করতে হবে এবং এটি সঠিক হতে হবে।
৩। দোষারোপ করার জন্য কাউকে খুঁজে বের করে।
আর আরেকটি বিষয় হলো, সমস্যা সমাধান করতে সাধারণত যে কাজটি করা হয় তা হলো, খুব দ্রুত সমাধান চাওয়া। বারবার বলি, ‘এখন আমি কী করব।’ আমরা হয়তো ভুলে যাই যে ‘সমাধান’ হলো একটি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। তবে আমরা তা প্রথমেই পেতে চাই। তাই ঠিক এখনই আমি কী করব এর উত্তরে বলা যেতে পারে, ‘আমি প্রথমেই নিজেকে শান্ত রাখব।’

যেকোনো জটিল সমস্যা অথবা এমন পরিস্থিতি যা আমরা আগে কখনও মোকাবেলা করিনি তা সমাধানের জন্যও মানব মস্তিষ্কের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। গবেষকদের মতে, এটি এমন একটি দক্ষতা যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে। ‘স্ট্রাইটাম’, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ মূলের ‘বেসল গ্যাংলিয়ার’ অংশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করে। মস্তিষ্কের সামনের কাছাকাছি ‘প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স’ অন্যান্য সমস্যাগুলোর সঙ্গে জটিল সমস্যা সমাধান করে। যখন সচেতনভাবে আমাদের সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা না করি তখনও কাজ করে। ‘ফ্রন্টাল লোব’ শারীরিক চলাচল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজের সমন্বয় করার কাজ করে; উচ্চতর জ্ঞানীয় দক্ষতা, যেমন সমস্যা সমাধান, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা ও পরিচালনা, ব্যক্তিত্ব ও আবেগীয় দিকগুলোর কাজ করে।

জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে কিছু কৌশল:

১। রাতের ঘুম
ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থার চেয়ে, রাপিড আই মুভমেন্ট (REM) ঘুম সরাসরি মস্তিষ্কে সৃজনশীল প্রক্রিয়াকরণ বাড়ায়। সহযোগী নেটওয়ার্কগুলিকে উত্সাহিত করে। মস্তিষ্কে নতুন ও দরকারি সংযোগ তৈরি করে, যা জেগে উঠলে ঘটে। তাই শান্তিপূর্ণ রাতের ঘুম আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে।

২। জীবনকে নিখুঁতভাবে গ্রহণ করা
প্রায়ই আমরা জীবন থেকে দূরে সরে যাই। আমাদের অবশ্যই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে আলোকিত করতে হবে।

অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের আরও আস্থাশীল, শক্তিশালী করে। জীবনবোধের স্বাধীনতা হলো খারাপের সাথে ভালো, কষ্টের সঙ্গে বিস্ময়, বেদনার সঙ্গে প্রেম এবং মৃত্যুর সঙ্গে জীবন! যখন এসব বিষয়গুলোকে মেনে নিতে পারা যায়, তখন আমাদের কাছে জীবন উপভোগ্য। যখন বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়, তখন নিজেকে সর্বোচ্চ সুযোগ দিয়ে ঢেলে সাঁজানো যায়।

৩। সময় নেয়া
কচ্ছপ ও খরগোশের গল্পটি আমাদের সবারই জানা। কচ্ছপ ধীর এবং অবিচলিতভাবে দৌড় প্রতিযোগিতাটি জিতেছিল। তাড়াহুড়ো করে, আমরা আসলে সফলতা থেকে আরও দূরে সরে যাই। সহজ ও সংক্ষেপ উপায় খুঁজতে গিয়ে আরও ভুল করি। পুরানো প্রবাদে আছে, ‘যত ধীরে, শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে যান, তত তাড়াতাড়ি সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যান”। এ ধরনের পদ্ধতি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত হওয়ার সর্বোত্তম উপায়।

৪। কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করা
আশীর্বাদের চেয়ে সমস্যার সংখ্যাই তুলনামূলক কম। আমাদের জীবনের অফুরন্ত আশীর্বাদগুলোর জন্য আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কৃতজ্ঞ হই? বারবার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলি। মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন জীবন বদলে দিতে পারে। ভালো কাজ খুঁজে বের করা এবং কৃতজ্ঞতার সাথে তা গ্রহণ করা মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এক যাদুকরি উপায়।

৫। সকল অনুভূতির (এমনকি বেদনাদায়কও) সঙ্গে থাকা

প্রায়শই আমরা আমাদের অনুভূতিগুলোকে ভীতিকর, ভারী ও বিভ্রান্তিকর মনে করি। তবে জীবনে সন্তুষ্টি, অর্থ-সম্পদ ও আনন্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের অনুভূতিগুলো দরকার। অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়া কেবল ব্যাকফায়ারই নয়, এটি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি থেকেও সরিয়ে দেয়। অনুভূতি হলো আমাদের ব্যক্তিত্বের ইঞ্জিনের গ্যাস, প্রেরণার উত্স। এগুলো হলো শক্তি, প্রাণশক্তি, জীবনের রস। এগুলো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনও ব্যক্তিত্ব, মাত্রা বা রঙ থাকবে না। কোনও আনন্দ, সৃজনশীলতা, বা মজা থাকবে না। আপনি, আমি আলাদা করে আমরা কেউই আমাদের অনুভূতি ছাড়া কিছুই নই।

৬। জীবনযাত্রার অংশ হিসাবে সাফল্য ও ব্যর্থতা গ্রহণ করা
সহানুভূতিশীল মনোভাব, জীবনের গতিশীল প্রক্রিয়া- চেষ্টা করা, সফল হওয়া, ব্যর্থ হওয়া এবং পুনরায় চেষ্টা করা নিজের মধ্যে স্থায়ী আস্থা অর্জনের একমাত্র উপায়।

৭। সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা
সম্পর্কগুলো এমনি এমনি যাদুর মতো হুট করে হয়ে যায় না। মনোযোগ, যত্ন ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বেড়ে ওঠে এবং টিকে থাকে। বিবাহ, পরিবার বা বন্ধুত্ব হলো গতিশীল, জীবন্ত অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন একটু একটু করে উপার্জন করতে হয়, যার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার প্রয়োজন। দূরত্ব অতিক্রম এবং সম্পর্ককে সম্মান করা একটি দৈনিক প্রক্রিয়া। আমরা কখনও একে অপরকে আঘাত করব এবং একে অপরের দ্বারা আহত হবো এই বাস্তবতাটি গ্রহণ করতে হবে। এই ব্যথা এড়ানো যায় না। আমরা কেবল মেরামত করতে পারি, সংশোধন করতে পারি, নিজেকে নিবেদিত করতে পারি। নিজেদের ভুলগুলির দায় গ্রহণ করি, দুঃখিত হই। নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করি। ক্ষমা করতে শিখি; অন্যের ক্ষমা গ্রহণ করি। আমরা নীচে পড়ি, নীচে পড়ে আবার উঠি। আর এটাই হলো সম্পর্কের বন্ধন।

সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি ধাপ মেনে চলা যেতে পারে।

১। সমস্যা চিহ্নিতকরণ
প্রধান সমস্যা কোনটি তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা সহজ হয়। অনেক সময় দেখা যায় আশেপাশের সমস্যা নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি। বুঝতে পারি না যে মূল সমস্যাটি সমাধান হলে অনেকটাই স্বস্তি।

২। অনর্থক আলোচনা এড়িয়ে চলা
একেক জনের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাধারা একেক রকম। তাই সহানুভূতিশীল ও ইতিবাচক ব্যক্তির সাথে সমস্যা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। একই সঙ্গে সবার মতামত গ্রহণ করলে আরো নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।

৩। বিকল্প সমাধান বিশ্লেষণ
সম্ভাব্য বিকল্প সমাধানগুলো তালিকাভুক্ত করতে হবে। প্রতিটি উপায়কে আলাদা করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করাই শ্রেয়। উপায়গুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, স্থান অথবা প্রয়োজনে অর্থায়নের উৎস চিহ্নিত করতে হবে।

৪। সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে ভাবা

সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে। সেরা উপায়টি কী হতে পারে এবং কেন তা সেরা তা নিয়ে ভাবতে হবে। অবশ্যই যেখানে অসুবিধা কম সেই উপায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৫। লিখিত ডকুমেন্টেশন
সব সময় স্মৃতির ওপর ভরসা না করাই শ্রেয়। উপায়গুলোর বিবরণ ও প্রভাব লিখিত আকারে থাকলে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। এটি ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনায়ও কাজে লাগতে পারে।

৬। ব্যর্থ হলে পুণরায় ভাবতে হবে
সবসময় পরিকল্পনা মাফিক সমাধান নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম ধাপে ফিরে যেতে হবে। জরুরি অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। বিকল্প উপায় নির্বাচন করতে সমস্যা হলে, পুণরায় সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে।

৭। নির্দিষ্ট সময়সীমা
সমস্যা নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকলে চলবে না। সমাধান পরিকল্পনার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। সমস্যার ধরন অনুযায়ী হতে পারে সেটি একদিন, একমাস, দশবছর কিংবা তারচেয়ে বেশি।

লেখক : সাইকোলজিস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments