ডা. হালিদা হানুম আখতার
একজন মায়ের গর্ভধারণ অনেক আনন্দের বিষয়। অনেক আশার ও প্রত্যাশার ব্যাপার। এটি খুশির আমেজ নিয়ে আসে, একটি পরিবার, দম্পতি ও একজন মায়ের কাছে।
তবে সেই সঙ্গে দম্পতি বা পরিবারের একটি দায়ও চলে আসে। শুধু গর্ভধারণ নিয়ে আনন্দ করলে হবে না, দায়িত্বও নিতে হবে। এটি হলো, একজন মা যখন জানবে, আমি সন্তানসম্ভবা হয়েছি, পরিবার জানবে আমার ছেলের বউ বা আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়েছে, তখন দায়িত্বের একটি লম্বা লিস্ট হয়ে যাবে।
দায়িত্বের মধ্যে পড়বে :
১. অ্যান্টিনেটাল কেয়ার
অ্যান্টিনেটাল কেয়ার বা প্রসবের পূর্ববর্তী সেবাগুলো নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রসবের পূর্ববর্তী সেবা কখন নেবে, কোথায় নেবে এবং কতবার নেবে – এসব বিষয় পরিবারকে জানতে হবে। পাশাপাশি একটি ক্লিনিকে গিয়ে এটি নেওয়া প্রয়োজন। বাড়িতে কাউকে ডেকে এটি হবে না। এই সেবার মধ্যে কিছু শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। মায়ের রক্তচাপ ঠিক রয়েছে কি না, গর্ভের সন্তান ঠিক সময়মতো বড় হচ্ছে কি না, তার ওজন ঠিকমতো বাড়ছে কি না, মায়ের রক্ত ঠিক রয়েছে কি না, মা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে কি না- দেখতে হবে। এসব বিষয় সুন্দর করে মনিটর করার জন্য প্রসব পূর্ববর্তী সেবা নেওয়া প্রয়োজন। অন্ততপক্ষে চারটি সেবা নিতে হবে।
২. পরিকল্পনা
গর্ভধারণ থেকে প্রসব- সুস্থভাবে করার জন্য একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পরিকল্পনার মধ্যে হলো, কোন ফেসিলিটিতে যাবেন, কে দেখবেন, কতবার যাবেন? এ ছাড়াও আরো বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।
যখন প্রসবের সময় কাছাকাছি হয়ে আসবে, তখন জানতে হবে, কোথায় ডেলিভারি হচ্ছে ? কোনো হাসপাতালে হবে, না কি প্রাইভেট ক্লিনিকে হবে, না কোনো সরকারি হাসপাতালে হবে, না কি কোনো এনজিও ক্লিনিকে হবে- এসব বিষয় আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন। ক্লিনিকের ফোন নম্বর নিজেদের কাছে রাখতে হবে। সেই ক্লিনিকে অ্যাম্বুলেন্স থাকলে, সেটির নম্বর রাখবেন।
পরিকল্পনা না করলে কী ক্ষতি ?
আমরা এখনো জানি যে বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হচ্ছে। এটি একটি বড় সমস্যা। কারণ, বাড়িতে আমরা সঠিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি পাচ্ছি না। প্রসবের সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে কোনো জটিলতা হলে, সে সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারে না।
আমি যেহেতু একজন গবেষক, গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, প্রশিক্ষণ নেই এমন কাউকে ডাকা হচ্ছে বা পুরুষ পল্লী চিকিৎসককে ডাকা হচ্ছে। উনি এসে হয়তো একটি ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছেন বা স্যালাইন দিয়ে দিচ্ছেন। তবে উনি পরীক্ষা করতে পারছেন না। সে কোনো রকম দক্ষতা প্রকাশ না করার কারণে মায়ের জটিলতা বাড়তে পারে। মায়ের একলামসিয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ের রক্তপাত হতে পারে। সন্তান ঠেলাঠেলি করে প্রসব হলেও দেখা যাবে, মারা যাচ্ছে। আবার অনেক সময় সন্তান প্রসব হয়, তবে ফুল বের হতে সময় লাগে। তখন হাত দিয়ে টানাটানি করে ফুল বের করে। এর জন্য রক্তপাত হয়ে মা মারা যেতে পারে।

ক্যাপশন : সন্তান প্রসবের আগে নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। ছবি : সংগৃহীত
৩. রক্তদাতা ঠিক করা
আরেকটি বিষয়ে আমরা খুব গুরুত্ব দিই। হঠাৎ মায়ের রক্তের দরকার হলে তার পরিবার থেকে রক্তদাতা আগে থেকেই ঠিক রাখতে হবে, যেন জরুরি সময় মাকে বাঁচানো যায়। এটি একটি বড় প্রস্তুতি।
৪. টাকা জমানো
ভালোভাবে প্রসবের জন্য টাকা প্রয়োজন। এই জন্য একটি পরিবারকে এর পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনমতো টাকা জমাবে। এই টাকাটা না নিলে কিন্তু সেবা নিতে পারবে না। না হলে কম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বাড়িতে নিয়ে আসলে ঝুঁকি বাড়বে। তাই টাকা জমাতে হবে। প্রয়োজনে গর্ভাবস্থার সময় থেকে মা একটি সঞ্চয়/ ব্যাংক বানাবে। যেখানে মা ও তার পরিবারের সদস্যরা একটু একটু করে টাকা জমাবে। এতে প্রসবের সময় সুবিধা হবে।
সুতরাং মায়ের বেঁচে থাকা এবং শিশুটি সুন্দরভাবে ও বলিষ্ঠভাবে প্রসব হওয়ার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেবা নিতে হবে এবং যতপোযুক্ত জায়গায় যেতে হবে। তাহলেই মা ও শিশুকে সুস্থভাবে রাখা সম্ভব।

লেখক : রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ