মো. জহির উদ্দিন
বাংলাদেশে তিন দশমিক আট ভাগ শিশুর মধ্যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা পাওয়া গেছে। বিদেশি গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের শতকরা দুই থেকে তিন ভাগের বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা থাকে। এই প্রতিবন্ধীদের ৭৫ ভাগ থেকে ৯০ ভাগের মৃদু মাত্রার সমস্যাটি রয়েছে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার তিনটি লক্ষণ থাকে। প্রথমত, এদের বুদ্ধি তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কম। ওয়েক্সলার ইন্টেলিজেন্স স্কেল অনুযায়ী এদের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক সত্তর বা এর কম থাকে।
দ্বিতীয়ত, জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতার ক্ষেত্রে এই শিশুদের যথেষ্ট ঘাটতি থাকে। যেমন, এদের অন্যদের সঙ্গে ভাববিনিময় বা যোগাযোগের দক্ষতা কম, নিজের যত্ন নিজে নেওয়ার ও সংসারে টিকতে হলে যে সাধারণ দক্ষতাগুলো থাকা দরকার, সেগুলোর ক্ষেত্রে ঘাটতি, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি, লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতি থাকে, পেশাগত কাজের দক্ষতা, অবসর বিনোদনের দক্ষতা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলোর ক্ষেত্রেও এদের ঘাটতি হয়।
তৃতীয়ত, ব্যক্তির মানসিক প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি তার আঠারো বছর বয়সের আগেই দৃশ্যমান হয়। বেশির ভাগ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুকে প্রথম দর্শনে বোঝা যায় না যে তাদের কোনো সমস্যা আছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের বিকাশ একটু দেরিতে হয়। তারা দেরিতে কথা বলতে শিখে, তাদের স্মৃতিশক্তি কম থাকে, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা ও ধৈর্য কম থাকে, কোনো কিছু শেখার ক্ষমতাও কম থাকে। যেমন, তাদের সামাজিক রীতিনীতি শিখতে সমস্যা হয়, তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ঘাটতি থাকে, নিজের যত্ন নিজে নেওয়া শিখতেও তাদের সমস্যা হয়। যেমন, অন্য শিশু হয়তো দিব্যি টয়লেট করে পরিচ্ছন্ন হয়ে বের হচ্ছে। সেখানে প্রতিবন্ধী শিশু একা একা এটা করতে পারছে না। তার বড়দের সাহায্য লাগছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শেখাতে গেলে অনেক ধৈর্য লাগে। এক জিনিস বারবার শেখাতে হয়। এ ধরনের শিশুদের মধ্যে লোকলজ্জার ভয়, কোন কথা বলা যাবে আর কোন কথা বলা যাবে না, সেই জ্ঞান কম থাকে।
মানসিক বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা চার ধরনের হয়।
১. মৃদু মাত্রার বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা (এদের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক থাকে ৫০ থেকে ৭০-এর মধ্যে)
২. মধ্যম মাত্রার বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা (এদের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক থাকে ৩৫ থেকে ৪৯-এর মধ্যে)
৩. চরম মাত্রার বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা (এদের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক থাকে ২০-৩৪-এর মধ্যে) এবং
৪. অতিরিক্ত চরম মাত্রার (এদের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক থাকে ২০-এর নিচে)।
উল্লেখ্য, বুদ্ধির একককে বলে আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক। বিভিন্ন ধরনের মনোবৈজ্ঞানিক বুদ্ধি পরিমাপক দিয়ে পরিমাপ করা যায়। যেমন, ওয়েক্সলারের পরিমাপক স্কেলগুলো দিয়ে পরিমাপ করা। উল্লেখ্য, সাধারণ মানুষের আইকিউ গড়ে ৯০ থেকে ১০৯-এর মধ্যে থাকে।
মৃদু মাত্রার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বুদ্ধির একক বা আইকিউ স্কোর থাকে ৫০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে। এরা সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারে। তবে তারা পরীক্ষায় সচরাচর খারাপ করে। হয়তো এক-দুটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে বিশেষ বিবেচনায় পাস করে। তারা নিজেদের যত্ন নিজেরা নিতে পারে। যেমন : একটু বড় হলে তার সাধারণ কেনাকাটা করা, গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে একা একা যাওয়া। এরা বড় হয়ে সাধারণ পেশায় নিয়োজিত হতে পারে।
মধ্যম মাত্রার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বুদ্ধাঙ্ক বা আইকিউ ৩৫ থেকে ৪৯-এর মধ্যে থাকে। এই স্তরের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের অনেক অল্প বয়সেই বোঝা যায়। তাদের ভাষার বিকাশ দেরিতে হয়, এদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ও সমাজে চলার জন্য প্রচুর সহযোগিতা দরকার হয়। তারা তেমন একটা লেখাপড়া করতে পারে না। তবে প্রচুর চেষ্টা করে তাদের সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে শেখানো যায়, তাদের সাধারণ কাজকর্ম, নিজের যত্ন নিজে নেওয়ার দক্ষতা কিছুটা শেখানো যায়। ইতিবাচক পরিবেশে বিশেষ তত্ত্বাবধানে তারা সীমিত পর্যায়ের পেশাগত কাজ করতে পারে। তাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলে স্পেশাল এডুকেশন টিচারদের তত্ত্বাবধানে শেখালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
যাদের তীব্র বা অতিরিক্ত তীব্র বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা থাকে, তাদের বুদ্ধাঙ্ক বা আইকিউ ৩৫-এর নিচে হয়। তাদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখতে হয়। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো তারা অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে শিখতে পারে। এদের মধ্যে প্রায়ই নানা ধরনের শারীরিক রোগ থাকে। এদের গড় আয়ু সাধারণ মানুষের থেকে বেশ কম।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট