Thursday, February 13, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যমিতা হক কেবল শিক্ষক নন, একজন গুরু

মিতা হক কেবল শিক্ষক নন, একজন গুরু

শাশ্বতী মাথিন

মিতা হককে প্রথম দেখেছিলাম, একুশে টেলিভিশনের পর্দায়। সালটা হবে ২০০০ বা ২০০১। গাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজা পর্যায়ের গান- ‘যদি জানতেম আমার কীসেরও ব্যথা, তোমায় জানাতাম।’ তাঁর কণ্ঠের তীক্ষ্ণতা, মাধুর্য আমার ১৩ বছরের মনকে এতোটাই আপ্লুত করেছিল, টেলিভিশনের সামনে ঝিম ধরে বসে গিয়েছিলাম।

মনে হচ্ছিল, আহা! এই মানুষটার কাছে যাওয়ার যদি সুযোগ পেতাম। তাঁর কাছে যদি গান শিখতে পারতাম! তখন আমি অবশ্য ছায়ানটের ছাত্রী। তবে মিতা হকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে শেখার লোভ সামলাতে পারিনি।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

পাঠকদের আগেই জানিয়ে রাখছি, এই লেখায় বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মিতা হকের সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলোই রোমন্থন করব। একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানের বাইরে গিয়েও কীভাবে গুরু বা মা হয়ে উঠতে পারেন, সেই গল্পই জানাবো।

টেলিভিশনে গান শোনার পর থেকে মিতা হক সম্পর্কে জানার আগ্রহটা বাড়লো। জানলাম, মিতা হকের জন্ম হয়েছে ১৯৬২ সালে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতে আরেক পুরোধা সাংবাদিক, শিল্পী, সংগীত গুরু ও সংস্কৃতজন ওয়াহিদুল হকের ভাতিজি তিনি। মিতা হক প্রথমে চাচা ওয়াহিদুল হকের কাছে গান শেখেন। পরে গান শেখেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সন্‌জীদা খাতুনের কাছে। তিনি বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পীদের মধ্য একজন।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

এরপর পার হয়ে গেল কয়েকটা বছর। এইচএসসি পরীক্ষার আগে বা পরপরই তাঁর বনানির বাসায় ব্যক্তিগতভাবে গান শেখা শুরু করি। শুরু হলো, মিতা হকের হাত ধরে আমার সংগীত জীবনের যাত্রা।

মিতা হককে ‘আপা’ বলেই সম্বোধন করতাম। তাঁর একটি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। মুখের দিকে তাকালেই যেন তিনি বুঝে যেতেন, কতটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে একটা মানুষ। মুখে তাকে কিছুই বলার প্রয়োজন পড়তো না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো নয়-ই।

এইচএসসির সময়টায় আমার জীবনে একটি ভীষণ ক্রাইসিস যায়। ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। মিতা আপার বাসায় গান শিখতে গেলাম। আপা মুখে একটা কথাও বললেন না। কোনো সান্ত্বনা বাক্যও দিলেন না, বকাঝকা তো নয়-ই। শুধু শেখালেন, রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান-
‘এই কথাটা ধরে রাখিস– মুক্তি তোরে পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে, সে পথে তোর যেতেই হবে ॥

অভয় মনে কণ্ঠ ছাড়ি, গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায়, ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে।

পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি, ছুটি তোরে পেতেই হবে।
চলার পথে কাঁটা থাকে, দ’লে তোমায় যেতেই হবে।

সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে, মরিসনে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভ’রে নিতে মরণ-আঘাত খেতেই হবে।’

গান শেখার একটি নিয়ম রয়েছে। সুর শেখার আগে অন্তত গানটাকে কয়েকবার পাঠ করতে হয়; গানের বাণী বা
কথাগুলোকে অনুধাবন করতে হয়। এতে এর বোধটাকে ভেতরে ধারণ করা যায়। এভাবেই আসলে ঠিকঠাক শব্দ চয়ন ও ভাবের মাধ্যমে একটি গান অন্যের অন্তরে পৌঁছে।

মিতা আপার এই শেখানো গানটিকে পাঠ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, কেন সেদিন তিনি আমাকে এটি শিখিয়েছিলেন। সেই সময় থেকে আজ অবধি এই গানটি হয়ে উঠেছে আমার জীবনিশক্তি, প্রেরণা। এখনো ভেবে অবাক হই, যেখানে মানুষের ক্রাইসিসের বেশিরভাগ মানুষই তিরষ্কার করে, ছোট করে, উপহাস করে সেখানে কীভাবে তিনি বুঝেছিলেন, আমার এখন ঠিক এই গানটিই প্রয়োজন! আপা বলেছিলেন, ‘তুই গানটাকে ছাড়িস না। অনেক বড় হবি।’

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর লেখাপড়ার চাপে, পারিবারিক ঝামেলায় গানটা আর হয়ে উঠছিল না। এরপর তো সাংবাদিকতার চাকরি, সন্তান। কিন্তু কোথায় যেন গান না করতে পারার একটি তীব্র যন্ত্রণা কাজ করছিল মনে।

মিতা আপার কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিল। ততদিনে গলায়ও জং ধরে গেছে। ছোটবেলার মতো আর সুর-তাল-লয়ে ঠিকঠাকমতো গাইতে পারি না; জড়তাও চলে এসেছে। গানটা আবার করবার জন্য ছটফট করছি।

১২ বছর পর আপাকে ফোন করলাম। বললাম, ‘মাথিন বলছি আপা।’ তিনি নামটা শুনেই চিনে গেলেন। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। এতো বড় সংগীত শিল্পী, কত আগে তাঁর ছাত্রী ছিলাম, কিন্তু আজও আমায় মনে রেখেছেন! বললাম, ‘গানটাকে আবার করব। বললেন, চলে আয়।’ শুরু হল, আবারও নতুন করে আপার কাছে গান শেখা।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

একদিনের কথা। সেই সময়টায় এনটিভিতে চাকরি করি।সামনেই বড় অনুষ্ঠান। বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ করে দৌড়াতে দৌড়াতে রিহার্সেলের জন্য আপার বাসায় গেছি। রিহার্সেলের এক পর্যায়ে আপা বললেন, ‘মাথিন, তোর জন্য টেবিলে খাবার রাখা থাকবে। অফিস থেকে যখনই আসবি খেয়ে নিস।’ পরে আরেকজন বড় আপার কাছ থেকে শুনেছিলাম, বাসার গৃহকর্মী টেবিল থেকে খাবার উঠাতে চাইলে, আমার জন্যই মিতা আপা রেখে দিতে বলতেন।

সেদিন আবারও অবাক হয়েছিলাম, এতো বড় একজন মানুষ; যাকে এক নামে বাংলাদেশের সবাই চেনে, তিনি কেবল আমার জন্য তাঁর টেবিলে খাবার রেখে দিচ্ছেন। এ তো কেবল মা-ই করতে পারে। আর আরো বিস্মিত হয়েছিলাম এই দেখে, তাঁর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো অহংবোধ ছিল না। কতদিন কতবার যে আপার বাসার টেবিলে খেয়েছি, তার কোনো হিসেব নেই। সেই ঋণ কখনোই শোধ করা যাবে না। তিনি কেবল দিতেই জানতেন। নিতেন না কখনো। রিহার্সেলের সময় বলতেন, ‘মাথিন যখন গান গায়, মনটা ভালো হয়ে যায়।’

 

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

কোভিডের সময় আমার খুব জ্বর এলো। ফোন দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কোভিড টেস্ট কর। আমি কান্তাকে (আমাদের একজন ডাক্তার আপা) বলছি, সে সব ঠিক করে দেবে।’ এই যে এতো আন্তরিকতা এটি সব শিক্ষকরা করেন না বা করা হয়তো সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে যিনি করেন, কেবল তিনিই হয়ে উঠতে পারেন, প্রকৃত গুরু।

আপার কাছে যে সবসময় আদরই পেয়েছি, তা কিন্তু নয়। বকাও খেয়েছি অনেকবার। গান ঠিকঠাকমতো না গাইতে পারলে, রেওয়াজটা না করলে ভীষণ রেগে যেতেন। তাঁর রাগও ছিল আগুনচড়া। ভয়ে ভয়ে থাকতাম আপা যেন কখনো রেগে না যায়। আসলে একে ভয় বললেও ভুল হবে। তাঁকে নিজের কোনো কাজ দিয়ে কষ্ট দিতে চাইতাম না।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

মিতা হক, ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক পান। ২০১৭ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়। একই বছর রবীন্দ্র সঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা’ দেওয়া হয়। ২০২০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একুশে পদক পান। এই দিনগুলো ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।

আজ ১১ এপ্রিল, আমার সংগীত গুরু, বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মিতা হকের প্রয়াণ দিবস। জীবনের প্রতিটা মুর্হূতে তাঁকে ভীষণভাবে মনে করি। এখনো কোথাও গান গাইতে গেলে বা বাসায় রেওয়াজ করতে বসলে, তাঁর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে হয়, তিনি শুনছেন। গানটাকে ভালোভাবে গাইলে তিনি খুশি হবেন।

মাঝে মাঝে মনে হয়, মিতা আপা কি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বা যেতে পারেন বা যাওয়া যায়? হয়তো তাঁর শরীরী অবয়বটুকু নেই আমাদের কাছে। কিন্তু তাঁর স্মৃতি, আদর্শতো এখনও রয়েছে শিক্ষার্থীদের ভেতর। তখনই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের সেই বাণী-

‘তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই।’

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments