Monday, January 20, 2025
spot_img
Homeমন জানালাভালোবাসা কারে বলি?

ভালোবাসা কারে বলি?

শাশ্বতী মাথিন

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মায়ার খেলা গীতিনাট্যে ‘মায়াকুমারী’ নামে কিছু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। এই মায়াকুমারীরা কুহকশক্তি প্রভাবে মানবমনে মায়ার সৃষ্টি করে। মানবমনের যেই প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ-মিলন, হাসি-কান্না, মোহ, লজ্জা রয়েছে; তার সবই মায়াকুমারীগণের খেলা। মায়াকুমারীগণ তাদের মায়ার জাল বিছিয়ে নবীন হৃদয়ে প্রেম রচনা করে।

রবিঠাকুরের লেখনীতে মায়াকুমারীগণ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হলেও এদের কর্মকাণ্ডকে কিন্তু আমরা প্রকৃতি, সৃষ্টি বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। স্রষ্টা বা প্রকৃতি যেমন তার মনের খেয়াল-খুশিমতো মানবের ভেতর প্রেম-বিরহের আবেদন তৈরি করে, ঠিক তেমনই মায়াকুমারীরা প্রতিনিয়ত প্রেম তৈরি করে যাচ্ছে।

মূলত, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের ভেতর তৈরি হয় ভালোবাসা-প্রেমের অনুভূতি। প্রেম মনকে চঞ্চল করে; করে তোলে অধীর। পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে অস্থির হয় ওঠে মানব হৃদয়। তবে ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে কিন্তু নানা মুণীর রয়েছে নানা মত। আবার প্রত্যেক মানুষই তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি করে নেয় নিজ নিজ ভালোবাসার সংজ্ঞা।

এক আড্ডায় বাংলাদেশি কবি ও ঔপন্যাসিক অসীম সাহার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভালোবাসা মানে কী ? বললেন, “মনের অন্তর্গত অনুভূতির ‍ক্ষীণতম প্রকাশ ও গভীরতম অপ্রকাশের নামই ভালোবাসা। ভালোবাসা বহুমুখী। কিন্তু শুধু যদি নর-নারীর ভালোবাসার কথা বলা হয়, তা হলে বলতে হবে, ‘কোনো ‍এক মানুষের তরে, কোনো ‍এক মানুষীর কিংবা কোনো ‍এক মানুষীর তরে কোনো ‍এক মানুষের’ হৃদয়ের গভীরতর আকর্ষণের নামই ভালোবাসা। লক্ষ জনম হৃদয়ের ভেতরে হৃদয় রেখেও যে হৃদয় তৃপ্ত হয় না, তারই আর ‍এক নাম ভালোবাসা।”

ছবি : কে-ক্র্যাফট
ছবি : কে-ক্র্যাফট

বাংলাদেশি চিকিৎসক ও সংগীতশিল্পী গুলজার হোসেন উজ্জ্বল ভালোবাসার সংজ্ঞায় বললেন, ‘যার সঙ্গ মনে শান্তি দেয়, তার সঙ্গ লাভের (মানসিক বা শারীরিক) বাসনাটাই ভালোবাসা।’ একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় নিউজ প্রেজেন্টার মোহসেনা শাওন জানালেন, তার কাছে ভালোবাসা মানে হলো, না পাওয়া।

ভালোবাসা কারও কাছে বন্ধুত্ব, কারও কাছে গভীর বিশ্বাস, আস্থা বা দায়িত্ববোধ। আবার কারও কাছে এটি হয়তো কেবল বোঝাপড়া, ছাড় দেওয়া। তবে মনের এসব আবেগীয় মিশ্রণগুলো ঘটে আসলে কাম থেকে। এমনটাই মনে করেছেন জার্মান মনোবিজ্ঞানী সিগমন ফ্রয়েড। তাঁর মতে, মানুষের ভেতর যতসব মানবিক আচার-আচরণ সবই যৌনতার প্রকাশ। ভালোবাসা-প্রেম বিষয়গুলো কেবল কামেরই আরেক নাম। তবে এ নিয়ে কিন্তু বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা যুক্তিতর্ক।

ভারতের রহস্যবাদী আধ্যাত্মিক গুরু রজনীশ ওশো একবার ভালোবাসা ও অধিকারবোধ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘অল্প কিছু বোঝাপড়া চাই। একটি মৌলিক সত্যকে স্বীকার করে নিতে হবে। প্রথমটি হলো, কেউ কারও জন্য জন্মায়নি। দ্বিতীয়টি হলো, ব্যক্তিকে কী রকম হওয়া উচিত বা হতে হবে, সেটির জন্য কেউ তোমার মতাদর্শকে মেনে নিতে কিংবা পরিপূর্ণ করতে পৃথিবীতে আসেনি। তৃতীয়টি হলো, তুমি নিজেই নিজ ভালোবাসার গুরু। তুমি তোমার খুশিমতো যত ইচ্ছে দান করতে পারো। কিন্তু অন্যের কাছ থেকে সেটি প্রত্যাশা করতে পারো না। কারণ, কেউ তোমার দাস নয়।’ এমনকি ভারতীয় এই পাবলিক স্পিকার বিয়েকেও ভুয়া প্রতিষ্ঠান নামে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। যে কোনো প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তির বিকাশের জন্য বড় একটি বাধা।’ তবে এ মতের বিরুদ্ধেও গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ। ধর্মবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, এতে ভেঙে পড়বে সমাজ-কাঠামো; বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে সমাজে।

 

ছবি : কে-ক্র্যাফট
ছবি : কে-ক্র্যাফট

বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় একবার ইশক কলকাতা নামে একটি রেডিও চ্যানেলে এসব বিষয়ে জানান, ভালোবাসা নেই বলেই ভালোবাসার কথা এত শোনা যায়। প্রেমের সঙ্গে সব সময় ওতপ্রোতভাবে মিলে থাকে ত্যাগ। ভালোবাসতে হলে তোমাকে ত্যাগ করতে হবে। তার ভালোতে বাস করতে হবে। তার যাতে ভালো হয়, তোমাকে তা-ই করতে হবে। এর জন্য যদি তোমাকে ত্যাগও করতে হয়, তাকে তাও করতে হবে। এখন যেসব প্রেমের কথা বলা হয়, সেগুলো একটা ইনফেচুয়েশন (মোহ)। কেবল একটি শারীরিক আকর্ষণ বা কোনো গুণাবলির প্রতি আকর্ষণ।

‘লক্ষ্য বা গোল ছাড়া বা পরিণতি ছাড়া যেই প্রেম জন্ম হয়, সেগুলো আসলে শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। একটা সময় বোঝাপড়ায় অসুবিধা তৈরি হয়েই যায়। আসলে যে কোনো সম্পর্কের ভেতরই বিশ্বস্ত থাকাটা খুব জরুরি।’ প্রেমের ধরন কেমন হওয়া চাই, এ নিয়ে এক আলাপচারিতায় সাইকোলজিস্ট ফারজানা ফাতেমা রুমী এসব কথাই বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে আবার বহুগামিতাকে খুব গুরুত্ব দেয়। এতে আসলে দাওয়াত দিয়ে ঝামেলা টেনে আনাই হয়। একজন মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, সবার প্রতি একই রকম আচরণ করা, সময় দেওয়া বা যত্ন নেওয়া। এগুলোকে কেবল ফ্যান্টাসাইজড সম্পর্কই বলা চলে। এসব সম্পর্ক অস্থিরতাই বাড়ায়।’

এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ট্রু লাভ বা সত্য ভালোবাসা বলে কি আসলেই কিছু রয়েছে ? উত্তরে তিনি বললেন, ‘রয়েছে। না হলে তো সমাজ, পৃথিবীর অবকাঠামো টিকত না। তবে ভালোবাসা কেবল নারী-পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে দেওয়া চাই সবার প্রতি। নর-নারীর প্রেমের বাইরে বেরিয়ে এসে ভালোবাসা হওয়া উচিত মানবমুখী।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments