– ফারজানা ফাতেমা রুমী
টিন এজ কিংবা কৈশোরকাল (১৩-১৯ বছর) হলো, মানব জীবনের এমন এক সন্ধিক্ষণ যখন একজন মানুষ শিশুকাল থেকে পূর্ণ বয়সের দিকে ধাবিত হয়। এটা হলো শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হবার সময়। এ সময় শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক। এ সময়টায় পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ব্যপকভাবে ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে। বয়ঃসন্ধিকাল একটি অনন্য ও গঠনমূলক সময়। যেখানে দরিদ্র হওয়া, শিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অপব্যবহার, বা সহিংসতার সংস্পর্শসহ একাধিক নেতিবাচক ঘটনা কৈশোর বয়সিদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত করতে পারে। তাই মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার উন্নতি করা এবং কৈশোরপ্রাপ্তদের প্রতিকূল অভিজ্ঞতা ও ঝুঁকির কারণগুলো থেকে রক্ষা করা তাদের সুস্থতার জন্য এবং যৌবনে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের চারপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের প্রাথমিক ধারণা না দেয়া হলে প্রায়শই তারা নিজস্ব ধারায় চিন্তা করে। এটি অনেক সময়ই তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাচ্চারা কী ভাববে এবং কী অনুভব করবে তা নিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে কিছু অব্যক্ত নিয়ম রয়েছে যেমন, ‘আমরা সাধারণত আবেগ, অনুভূতি নিয়ে কথা বলি না’, ‘ছেলেদের কান্না করা উচিত নয়’ বা ‘সবকিছু ঠিক আছে বলে ভান করা’ ইত্যাদি। তবে এসব থেকে নিজেদের অজান্তেই দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।
এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে একটি অস্থির সময়কাল পার করে। প্রায়শই অভিভাবকরা ‘সক্রিয় শ্রবণ’ বলতে কী বুঝায় তা বুঝতে পারেন না। সক্রিয় শ্রোতা হওয়ার অনুশীলনকে অবহেলা করা কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে কেবল দুর্বল যোগাযোগের কারণ নয়, এটি পিতামাতার দায়িত্বকেও ক্ষুণ্ণ করে। আপনার সন্তানের প্রয়োজনগুলো আপনার নিজের থেকে কিছুটা আলাদা। তার এমন ব্যক্তির দরকার যিনি মনে করেন না যে তিনি ‘সবচেয়ে ভাল জানেন।’ একজন সক্রিয় শ্রোতা মনোযোগী, যত্নশীল ও আপোস করতে ইচ্ছুক। তিনি জানেন ব্যক্তির আচরণের সঙ্গে একমত না হলেও কীভাবে কথা বলে সমবেদনা জানাতে হয়। তিনি উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানান মৌখিকভাবে ও মনোযোগী দেহের ভাষার মাধ্যমে।
কিশোর-কিশোরীদের মন খারাপের সময় কীভাবে পাশে থাকবেন :
যখন কোনো সমস্যা হয় আমাদের মস্তিষ্ক প্যানিক মোডে পরিবর্তিত হয়। ‘অ্যাড্রেনালাইন’ দেহকে এই হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করে বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য শিরাগুলোতে পাম্প করে। তবে প্যানিক মোডে প্যারেন্টিং সাধারণত ভালো হয় না। ‘অক্সিটোসিন’ একটি প্রাকৃতিক স্ট্রেস রিলিভার। যখন আমাদের এই হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন তা উদ্বেগ কমায় এবং শিথিল করতে আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে। একটি উচ্চতর ‘অক্সিটোসিন’ স্তর নিম্ন রক্তচাপ ও হার্টের হারের সঙ্গে সম্পর্কিত। একে ‘লাভ হরমোনও’ বলা হয়। তাই শিশুর আবেগীয় মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করুন, জড়িয়ে ধরুন যাতে সে বুঝতে পারে আপনি তাকে ভালোবাসেন, যত বড় বিপদই হোক আপনি তার পাশে আছেন।
১। মনোযোগ দিয়ে শোনা
সুস্পষ্টভাবে আপনার বাচ্চাকে সত্যিই আপনার শুনতে হবে। এর অর্থ আপনার মুখ বন্ধ করে কান খোলা রাখা। মন্তব্য না করে শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে যে আপনি তাকে শুনছেন।
২। মাল্টিটাস্কিং নয়
ফোনকে সরিয়ে রাখা বা টিভি বন্ধ করার মতো সাধারণ কাজগুলো করতে ভুলে গেলে চলবে না। এ সময়টা মজাদার অন্য পরিকল্পনা করার বিষয়গুলো কিম্বা রাতের খাবারের জন্য কী পরিবেশন করবেন বা আপনার অফিসের কাজ ইত্যাদি ভেবে, এই কথোপকথনটি কতটা সময় নেবে এ সম্পর্কে না ভাবাই ভালো।
৩। সুস্পষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা
যদি আপনার সন্তানের কথা বিভ্রান্তিকর বা অস্পষ্ট হয় তবে বলতে পারেন, ‘এ বিষয়ে তুমি আরও কিছু বলতে পার’ বা ‘আর কি কি হয়েছিল।’ প্রশ্নগুলো কঠোর জিজ্ঞাসাবাদে পরিণত না হয়ে আবেগপূর্ণ ও কৌতূহলী হতে হবে। আপনি যে তাকে দোষারোপ করবেন না এমন আচরণ বজায় রাখতে হবে। নেতিবাচক বা হাইপারফোকাস হওয়ার পরিবর্তে আপনার সন্তানের কথাতে ইতিবাচক, সত্য বা সহায়ক কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে।
৪।পুনরাবৃত্তি না করা
প্রায়শই শোনার পরিবর্তে আমরা কিছু শেখানোর চেষ্টা করি। নিজের মতামত বা নিজের জীবনের উদাহরণ দিই। যখন আমাদের বাচ্চারা শোনে না, আমরা পুণরায় সংশোধন করি। আপাতত শুধুই শুনুন।
৫। সমস্ত আবেগকে গ্রহণ করা
কিশোর-কিশোরীদের আবেগে শিশুদের ও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় পার্থক্য রয়েছে। কথা শোনার আগেই ‘শান্ত হও’ বা ‘কান্না থামাও’ বলার তাগিদ প্রতিরোধ করতে হবে।বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার চেষ্টা না করে, আপনার সন্তানের বিশৃঙ্খলায় নিজেকে শান্ত রাখার কাজ করতে হবে। তাকে বলতে পারেন, ‘আমি বুঝতে পারছি যে তোমার খুব খারাপ লাগছে’ বা ‘বুঝতে পারছি এ বিষয়টি তোমাকে উদ্বিগ্ন করছে।’
৬। শান্ত থাকা
আপনার সন্তানের কথায় অতিরিক্ত বিচলিত বোধ করলে আপনি ডিপ ব্রেথ নিতে পারেন যাতে আপনি আবার ফোকাস করতে পারেন। এখনই শান্ত হতে না পারলে সময় নিন। বলতে পারেন, ‘আমি সত্যিই তোমার কথা শুনতে চাই, তবে আমার মন খারাপ হচ্ছে। যদি পাঁচ মিনিটের বিরতি নিতে পারি তবে আমি আরো ভালোভাবে ফোকাস করতে পারবো।’
যদিও ‘সক্রিয় শ্রোতার’ শিল্পকে নিখুঁত করতে অনুশীলন প্রয়োজন। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন যে সক্রিয় শ্রবণে সন্তানের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি কম হয়, পিতা-মাতার প্রতি তাদের আস্থার উন্নতি ঘটে এবং চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে উত্সাহিত করে। আরও আত্মবিশ্বাসী ও স্ব-সচেতন হয়ে উঠে এবং তাই পিয়ারগ্রুপ বা সমবয়সীদের চাপকেও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হতে পারে। সে জানবে যে যাই ঘটুক না কেন, তার বাবা-মায়ের মতো শ্রোতা তার জীবনের রয়েছে।
লেখক : সাইকোলজিস্ট ও বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সংগঠনের আজীবন সদস্য।