ডা. মো. আসাফুজ্জোহা রাজ
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, ছত্রাক জনিত এ রোগ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদেরেও ভাবিয়ে তুলছে । এর ভেতরই ভারতের একাধিক রাজ্য রোগটিকে মহামারী পর্যায়ে সতর্ক করছে। কোভিড পরবর্তী জটিলতা হিসাবে এ রোগকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন ।
রোগের ধরন
মিউকর নামক বিশেষ ধরনের ছত্রাক সাধারণত ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে, পচনশীল জৈব পদার্থে, পচাঁ পাতা বা কাঠ ও গাছে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, পঁচা সবজি ও ফলে জন্ম নেয়। সাধারণত অনুকূল পরিবেশ পেলে এরা বাতাসের মাধ্যমে মানব শরীরে নাক ও মুখ দিয়ে অথবা চামড়া কেটে গেলে বা পুড়ে গেলে সেই ক্ষত স্থান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মিউকরমাইকোসিস (mucormycosis) বা ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাস নামক জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারে প্রয়োজনীয় অংশ ও ব্যবহৃত পানি যেন জীবাণুমুক্ত থাকে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণ অবস্থায় এটি ছোঁয়াচে রোগ নয়।
সাধারণ উপসর্গ
ফাঙ্গাস শরীরের কোথায় বিস্তার করছে তার ওপর নির্ভর করে উপসর্গ প্রকাশ পায়। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে
মাথাব্যথা, নাক বন্ধ, নাক দিয়ে কালো বা খয়েরী কিছু বের হওয়া, শ্বাস কষ্ট, নাকের ওপর কালো বা ধূসর বর্ণ, মুখের মধ্যে তালু বিবর্ণ, জ্বর, মুখের এক পাশ ফুলে যাওয়া, দৃষ্টি শক্তির তারতম্য, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, কাশিঁতে রক্ত, বুকে ব্যথা ইত্যাদির এক বা একাধিক উপসর্গ প্রকাশ পায়।
উদ্বেগের কারণ
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আমাদের দেশে আগেও ছিল, তবে প্রকৃতি প্রদত্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের এই ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে নিরোগ রাখত। তবে চলমান কোভিড মহামারিতে রোগটিকে নিয়ে নতুন করে চিন্তার কারণ হলো, কোভিড পরবর্তী জটিলতা থেকে এ রোগ শরীরে বাসা বাঁধছে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে কোভিড জটিলতা মোকাবিলায় ফুসফুসকে রক্ষা করতে স্টেরয়েড ব্যবহার হচ্ছে, যেটি শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধের ব্যবহার রক্তে শর্করার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
চিকিৎসা গবেষণা বলছে, কোভিড পরবর্তী জটিলতা ও ডায়াবেটিস রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সর্বাধিক। এ ছাড়া অঙ্গ প্রতিস্থাপন, অপুষ্টি, শারীরিক দুর্বলতা, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষ ঝুঁকিতে থাকতে পারে।
ভারতে এ রোগ ছড়ানোর পিছনে কিছু অবৈজ্ঞানিক, অনির্ভরযোগ্য ধারণাকেও দায়ী করা হচ্ছে। যেমন : কোভিড রোধে গোমূত্র ও গরবের ব্যবহার।
রোগের ভয়াবহতা
দ্রুত এ রোগ শণাক্তের মাধ্যমে চিকিৎসায় না গেলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। দ্রুত সংক্রমণটি নাক, সাইনাস, ফুসফুস, চোখ, হার্ট ও মস্তিস্ককে আক্রান্ত করে ফেলে। আবার চিকিৎসা পদ্ধতিতে যে ওষুধ প্রয়োজন তাতেও রয়েছে উচ্চ মাত্রায় পার্শ্বপতিক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত অংশে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। জীবন বাচাঁতে উপরের চোয়াল এমনকি চোখেও বড় ধরনের অস্ত্রপচারের প্রয়োজন পড়তে পারে, এমনকি অঙ্গহানির আশঙ্কা থাকে। এ জন্য বিশেষজ্ঞগণ এ রোগের চিকিৎসায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট, মেডিসিন, স্নায়ু রোগ, নাক-কান- গলা, চর্মরোগ, চক্ষু, ডেন্টাল ও শৈল্য বিশেষজ্ঞদের যৌথ পরামর্শে সম্পন্ন করার বিষয়ে উৎসাহিত করছে।
করণীয়
আতঙ্কিত না হয়ে এখনই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সচেতন হতে হবে। কারণ আমাদের দেশে এখনো এ রোগের উপস্থিতির কথা গণমাধ্যমে উঠে আসলেও নিশ্চিত হয়নি। কোভিড পরবর্তী ডায়াবেটিস ও স্টেরয়েড থেরাপির রোগীরা নিয়মিত ব্লাড সুগার চেক করে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ও পুষ্টিবিদের পরামর্শে সুষম খাদ্যতালিকা মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের ফলের মৌসুমে আম, কাঁঠাল, তরমুজ, লিচুর মতো মিষ্টি ফল খাওয়ার বিষয়ে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুদ রাখতে স্বচেষ্ট থাকতে হবে। শরীরের কোন ক্ষতস্থান উন্মুক্ত রেখে বাইরে যাওয়া যাবে না, ঘরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে, বিছানার চাদর ও পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
কোভিড সন্দেহে বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন ঝুঁকির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে স্টরয়েড গ্রুপের ওষুধ ও ব্ল্যাক ফাঙ্গেসের ইনজেকশন।
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষা অতি জরুরি। অনেক সময় মুখের মধ্যেও এই জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। সঠিক নিয়ম জেনে মুখের পরিচর্চা ও চিকিৎসকের পরামর্শে জীবাণুনাশক মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা যেতে পারে। কোভিড থেকে মুক্তি পেয়েও স্বাস্থ্য সচেতনতায় স্বচেষ্ট থাকার মাধ্যমে এ রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া আমাদের কাছে নতুন এ রোগ সম্পর্কে কোন তথ্য অনুসরণ করা বোকামী হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কোভিড রোধে পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বাসার বাইরে গেলে পরিস্কার ও শুকনো মাস্ক সঠিকভাবে পরিধান কোভিড ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোধে সর্বাধিক কার্যকরী।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, রাজ ডেন্টাল সেন্টার
কলাবাগান বশির উদ্দিন রোড
সদস্য সচিব, বিএফডিএস
গণমাধ্যম স্বাস্থ্য প্রতিবেদক ।
০১৯১১৩৮৭২৯১