শাশ্বতী মাথিন
একটা সময় কেবল কিছু নির্দিষ্ট পেশাতেই নারীকে চিন্তা করা হতো। কিন্তু সেই অচলায়তন ভেঙে নারী তাঁর কাজের বিস্তার ঘটিয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে। নারীরা ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসছেন সৃজনশীল মাধ্যমগুলোতে। কেবল ক্যামেরার সামনে অভিনেত্রী বা উপস্থাপক হয়েই নয়, পেছনে থেকেও সে পরিচালনা করছে অনুষ্ঠান বা চলচ্চিত্র। নারী সমানতালে কাজ করে চলেছে ক্যামেরার সামনে ও পেছনে। তেমনই একজন নারী জাকিয়া সুলতানা। যিনি একাধারে অনুষ্ঠান প্রযোজক ও উপস্থাপক।
তিনি বর্তমানে কাজ করছেন নেক্সাস টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক হিসেবে। পাশাপাশি নেক্সাস টেলিভিশনের ‘সাতদিন’ অনুষ্ঠানের একজন অন্যতম উপস্থাপক তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত নাট্যশিল্পী। এর আগে কাজ করেছেন বৈশাখী টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক হিসেবে। তিনি ‘কী কমিউনিকেশন’ বিজ্ঞাপন সংস্থায় ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্ট হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। যুক্ত রয়েছেন পাপেট থিয়েটার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সেন্টার অব বাংলাদেশের একজন সদস্য হিসেবে।
এতো যার গুণ, নারী হিসেবে তাঁর চলার পথটা কেমন ছিল? উত্তরে জানান, একজন নারীকে কর্মক্ষেত্রে এগোতে হলে পুরুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। নারী উর্ধ্বতন অবস্থায় কাজ করছে এটা অনেকে মেনে নিতে পারে না। পুরুষের তুলনায় নারী এগিয়ে যাবে, এটা যেন মেনে নেওয়া এই সমাজের জন্য কঠিন। তবে আমি এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছি। আমার পরিবারের সদস্য এবং অফিসের সহকর্মীরা কাজের ক্ষেত্রে বেশ সহযোগিতা করেছে। আর নেক্সাস টেলিভিশনের পরিবেশ ভীষণভাবে নারীবান্ধব। এখানে কাজ করতে অসুবিধা হয় না।
‘তবে ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে আমার সন্তান জন্ম হওয়ার পর একটু অস্থিতিশীল অবস্থায় পড়তে হয়েছিলো। আসলে সন্তান জন্মের পর নারীর ক্যারিয়ার ব্রেক একটি সাধারণ সমস্যা। সন্তানকে কোথায় রেখে অফিস করবো, এ নিয়ে খুব দ্বিধায় পড়ে যাই সেই সময়। তখন একটি বিরতি পড়ে আমার জীবনে। সেখান থেকে আবার কাজে ফেরা। নতুন করে নিজের অবস্থান তৈরি করা। সময়টা সহজ ছিল না। এভাবেই এগোতে হয়েছে। আমার ধারণা বাংলাদেশে ডে কেয়ার ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় অনেক কর্মজীবী মা-ই এই সমস্যায় পড়েন; ঝরে পড়েন কর্মক্ষেত্রে’, বলছিলেন তিনি।
জাকিয়া সুলতানা এসএসসি পাশ করেন পাবনা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এইচএসসি শেষ করেন পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজে। এরপর ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। এখান থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি করেন।
‘প্রযোজক হিসেবে আমার কাজের শুরুটা হয় বৈশাখী টেলিভিশনে। ড. রশীদ হারুন স্যারের মাধ্যমে বৈশাখী টেলিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। এরপর ইন্টারভিউ দিই। সিলেক্ট হবার পর সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু হয়। এখান থেকেই ধীরে ধীরে আমার সব শেখা। বৈশাখী টেলিভিশনে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, হায়দার রিজভী, খ. ম হারুন, ম হামিদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, ইশতিয়াক রেজা, মজিবুর রহমান দিলু। তাঁদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি। নেক্সাস টেলিভিশন পেয়েছি সানাউল্লাহ লাবলু, মনজুর আহমেদ, মহিউদ্দিন টিপু, জিয়াউল হক রাসেলের মত অভিভাবক সহকর্মী। তাঁদের কাছে প্রতিনিয়ত শিখছি। কাজের ক্ষেত্রে সবসময় তারা গাইড লাইন দেন। তাঁদের শিক্ষা আমাকে সমৃদ্ধ করে প্রতিনিয়ত। উপস্থাপনায় যুক্ত হবার ক্ষেত্রে মহিউদ্দিন টিপু ও আমীন আল রশীদ ভাইয়া সবসময় উৎসাহিত করেছেন,’ বলেন তিনি।
২০২১ সালের নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে নেক্সাস টেলিভিশনে শুরু হয় ‘লেডিস ক্লাব’ নামে একটি অনুষ্ঠান। এর মধ্যে অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘নেক্সাস লেডিস ক্লাব’ পরিণত হয়েছে হাজার হাজার নারীর প্রাণের আড্ডায়। নারীদের নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়াতে অনেক অনুষ্ঠান প্রচারিত হলেও একে একদমই ভিন্নধর্মী বলা চলে। এই অনুষ্ঠানটির প্রযোজক জাকিয়া সুলতানা। এ ছাড়া এই টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘তুমিই প্রথম’, ‘তারকা মা ও সন্তানকে নিয়ে অনুষ্ঠান ‘স্টার মম’, দুটির প্রযোজকও তিনি।
নিজের কাজের প্রসঙ্গে জাকিয়া সুলতানা জানান, লেডিস ক্লাব-এর ক্ষেত্রে শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল সব শ্রেণি-পেশার নারীদের নিয়ে অনুষ্ঠানটি সাজানো। এখানে অংশ নিতে পারে সেলিব্রেটিরা ছাড়াও উদ্যোক্তা, গৃহিনী, সাংবাদিক, লেখক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, চিকিৎসক, নৃত্যশিল্পী ও রাজনীতিবিদগণ। যারা নিজেদের ভাবনা, মনের কথা তুলে ধরতে চায় তারা প্রত্যেকেই লেডিস ক্লাবের স্টুডিওতে অতিথি হতে পারে। কেবল বাংলাদেশেরই নয়, অন্যান্য দেশেরও নারী সেলিব্রেটি ও অতিথিরা অংশ নেয় অনুষ্ঠানে। ‘তুমিই প্রথম’ অনুষ্ঠানে চিকিৎসক, ট্রেন চালক, শিল্পী- বিভিন্ন সেক্টরে যিনি প্রথম নারী, তার বায়োগ্রাফি নেওয়া হয়। এটিও বেশ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। পাশাপাশি ‘স্টার মম’ নামে অনুষ্ঠানটিও বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে দর্শকের কাছে। ইতোমধ্যেই নেক্সাস টেলিভিশন নারীবান্ধব চ্যানেল হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য আনন্দের।
‘একজন নারীকে সামনে এগোতে হলে অবশ্যই নিজের কাজের প্রতি ভীষণ ডেডিকেটেড হতে হবে, সৎ থাকতে হবে। কেবল নারী নয়, যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই বিষয়টি এমন। প্রতিবন্ধকতা আসবেই। এসব ভেবে হয়তো মন খারাপ হবে, কষ্ট লাগবে। কিন্তু সবকিছু মাড়িয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই গন্তব্যে পৌঁছুনো যাবে’,- বলেন তিনি।