ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা মেয়েদের খুব প্রচলিত একটি সমস্যা। সত্যি বলতে কি, পিরিয়ডের সময় তলপেটে ব্যথা অনুভব হয় না এমন নারীর সংখ্যা খুবই কম। সাধারণত অল্প বয়সেই বেশি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যথাটা সহনীয় মাত্রাতেই থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে যদি ব্যথাটা এমন হয় যে সেটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায় এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যঘাত ঘটায় তাহলে সেটাকে সমস্যা হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
মেয়েদের এই সমস্যাটিকে বলে ডিজম্যানোরিয়া। ডিজম্যানোরিয়া দুরকম হতে পারে। প্রাইমারি ডিজম্যানোরিয়া, সেকেন্ডারি ডিজম্যানোরিয়া।
প্রাইমারি ডিজমেনোরিয়া
ডিজমেনোরিয়ার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলে, সেটাকে বলে প্রাইমারি ডিজমেনোরিয়া। সাধারণত অল্প বয়েসি, বিশেষ করে ১৬ থেকে ২৪ বছরের মেয়েদের বেশি হয়। তলপেটের পেশিগুলোর অতিসংবেদনশীলতা, কিছু হরমোনের প্রভাব, মানসিক চাপ, হতাশা, বিষণ্ণতা, কম ওজন ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যথা এমনিতেই সেরে যায়। অনেক সময় বিয়ের পর সন্তান নিলে প্রথম প্রসবের পর এই ব্যথা নিজে নিজে সেরে যায়।
সেকেন্ডারি ডিজমেনোরিয়া
বিশেষ কোনো কারণে পিরিয়ডের সময় ব্যথা হলে, তাকে সেকেন্ডারি ডিজমেনোরিয়া বলে। জরায়ুর ইনফেকশন, পলিপ, টিউমার জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি কারণে পিরিয়ডের সময় ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যথার নেপথ্যের কারণটির চিকিৎসা করলে এটি আপনা থেকেই সেরে যায়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রাইমারি ডিজমেনোরিয়ার ক্ষেত্রে আসলে তেমন কোনো পরীক্ষা নেই। সেকেন্ডারির ক্ষেত্রে কারণ খুঁজতে গিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। এর মধ্যে আল্ট্রাসোনোগ্রাম হলো খুবই কাজের একটি পরীক্ষা। জরায়ুতে টিউমার বা পলিপ থাকলে বা জন্মগত কোনো ত্রুটি থাকলে তা আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে সহজেই ধরা পড়ে। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান করারও দরকার হয়। এ ছাড়াও বিশেষ কিছু হরমোনের পরীক্ষা করে দেখা হয়। রক্তের রুটিন পরীক্ষা, প্রস্রাবের পরীক্ষা, কিছু টিউমার মার্কার এর কারণ খুঁজতে সাহায্য করে।
চিকিৎসা
কাউন্সেলিং হলো প্রাইমারি ডিজমেনোরিয়ার প্রধান চিকিৎসা। পিরিয়ড সম্পর্কে মেয়েদের বোঝাতে হবে। ব্যথার কারণ সম্পর্কে সচেতন হোন। খুব খারাপ কিছু যে হয়নি- এই মর্মে আশ্বস্ত করতে করুন। সেকেন্ডারি ডিজমেনোরিয়ার ক্ষেত্রে ব্যথার কারণটি খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। ইনফেকশন থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথার মাত্রা অনুযায়ী প্যারাসিটামল, মেফেনামিক এসিড, ন্যাপ্রোক্সেন সোডিয়াম, টাইমোনিয়াম মিথাইলসালফেট প্রভৃতি ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
পিরিয়ড শুরুর আনুমানিক দশদিন আগে থেকে শুরুর দশদিন পর্যন্ত ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেলে ব্যথা কিছুটা কম হয় বলে কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে। তবে এগুলো খুব প্রতিষ্ঠিত কোনো তথ্য নয়।

পিরিয়ডের ব্যথা নিরাময়ের কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা
গরম স্যাঁক
বোতলে বা হটওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে বা কাপড় গরম করে তলপেটে স্যাঁক দিলে ব্যথা কমে । এটা করতে হবে প্রতি সপ্তাহে একটানা তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ মিনিট করে।
সিজ বাথ
কোমর পর্যন্ত কুসুম গরম পানিতে ডুবিয়ে বসে থাকা যেতে পারে। তিন থেকে চার মিনিট কুসুম গরম পানিতে বসে থাকতে হবে। মাঝখানে দুই মিনিটের বিরতি দিয়ে এভাবে আবার ২০ থেকে ২৫ মিনিট বসবেন। এভাবে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কাজটি করতে হবে।
কেজেল ব্যায়াম
এটা একটা বিশেষ ধরনের ব্যায়াম। মূত্রনালী ও মল দ্বারের চারপাশের পেশি এবং তলপেটের ও শ্রোণি চক্রের পেশিগুলোকে শক্তভাবে সংকুচিত করে তিন সেকেন্ড ধরে রেখে আস্তে আস্তে শিথিল করতে হবে। এভাবে সারদিনে ১০ থেকে ১৫ বার করুন। এটাকে বলে কেজেল ব্যায়াম। কেজেল ব্যায়াম ডিজমেনোরিয়ার ব্যথা কমাতে খুব সাহায্য করে।
মেয়েদের সঙ্গে মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। বয়ঃসন্ধির আগেই মেয়েদের এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করুন। এই সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার উপায়, সমস্যা হলে তার সমাধানের উপায় ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে হবে। পরিবারের বয়োজ্যাষ্ঠ বা স্কুলের শিক্ষিকারা কথা বললে অল্প বয়সি মেয়েদের এসব নিয়ে ভীতি ও অস্বস্তি কেটে যাবে।
লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ