সাতকাহন২৪.কম ডেস্ক
নারী ও পুরুষের একে অপরের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতা পৃথিবীকে করে তুলতে পারে সুন্দর আবাসস্থল। এমন কথাতো হরহামেশাই বলা হয়। তবে এই ধারণা পোষণ বা প্রকাশ করলেও এর বাস্তবিক প্রয়োগ কতটুকু দেখা যায় ?
নারী আজকে যে জায়গায় পৌঁছেছে এর জন্য তাকে করতে হয়েছে অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রয়েছে তেমনই একটি প্রেক্ষাপট। ১৮৫৭ সালে শ্রমজীবী নারী ন্যায্য মজুরি, দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস ও লিঙ্গ সমতার দাবিতে নিউইয়র্কের পথে নামে। তারপর থেকেই ধারাবাহিকতা শুরু। নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে অনেক সংগ্রামে উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসে।
সেইসব প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রেখে বর্তমানের দিকে তাকালে, এখন এই সময়ে এসে নারী কর্মক্ষেত্রে কতটা বৈষম্যহীন কর্মক্ষেত্র পাচ্ছে, এগিয়ে চলার পথ তাদের কতটা বন্ধুর বা মসৃণ- এই নিয়ে আমরা তুলে ধরছি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর ভাবনা। দুই পর্বের এই লেখায় এটি প্রথম পর্ব। এখানে থাকছে পাঁচ নারীর বক্তব্য।

১. মোহসেনা শাওন
সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার এনটিভি
নারী আসলে এখন অনেক এগিয়েছে বলা যায়। তবে কিছু জায়গায় তারা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে এটাই বলবো। যেমন : গ্রামাঞ্চলে নারী পিছিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে। স্বাস্থ্যগত বিষয়টি গ্রামাঞ্চল খুবই নাজুক। শহরেও দেখা যায় নিম্নবিত্ত নারীরা অবহেলিত স্বাস্থ্যজনিত ব্যাপারে। তারা রুটিনমাফিক ডাক্তারের কাছে যায় না। নারীশরীরবৃত্তিয় যেসব অসুখ রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে তারা উদাসীন। যেমন : জরায়ুমুখের ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ঋতুস্রাব জনিত জটিলতা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা ইত্যাদি। অবহেলা ও সচেতনার অভাবে এসব রোগ থেকে মৃত্যুও আমরা দেখি। সেই দিক থেকে নারী পেছনে পড়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে, একটু উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মেয়েদের যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়, নিম্নবিত্তরা কিন্তু সেভাবে আগায় না। একটা পরিবারে চারজন সন্তান থাকলে, সেখানে দুইজন মেয়ে ও দুইজন ছেলে থাকলে, তারা হয়তো চিন্তা করে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবে। তাদের পড়ালেখা শেখালে সংসারের হাল ধরবে। মেয়েদের ব্যপারে চিন্তা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেবে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।
গ্রামাঞ্চলে নিম্নবিত্ত যারা রয়েছে একেবারেই খেটে খাওয়া মানুষ, তারা মেয়েদের দিয়ে বাইরে কাজ করাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সেখানে মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টা অনেক সময় ধার্তব্যের মধ্যেই আসে না।
সাইবার সিকিউরিটির দিক থেকে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। আবার এখনো এই সময়ে এসে মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়, যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের পিছিয়ে পড়তে হয়; ঘর থেকে বের হতে পারে না। এইরকম কিছু ব্যাপার রয়েছে যেগুলোর জন্য মেয়েরা নিরাপদ নয়।
কর্মক্ষেত্রের কথা বললে সেখানেও নারীরা সেক্সচুয়াল হ্যারেজমেন্টের শিকার হচ্ছে, যে কারণে মেয়েদের দেখা যায় সেই চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে। অন্য জায়গায় শিফট হচ্ছে বা কাজের ধরন পরিবর্তন করে ফেলছে। সেখানে তখন তো একটা নারী পিছিয়েই যায়।
নারীর এগিয়ে যেতে হলে যে জিনিসগুলো সবচেয়ে বেশি দরকার সেগুলো হলো- শিক্ষা, নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও চিকিৎসা। আমার যেটা মনে হয়, একটা মেয়ে শিক্ষিত হতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যায়। যখন একটা মেয়ে শিক্ষিত হতে পারে তখন তার পরিবারের হালটাও সমানভাবে ধরতে পারে, একটা ছেলের পাশাপাশি। পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শিক্ষিত হলে এবং কর্মক্ষম হলে সংসারটা ভালো করে চালাতে পারে। এখন কিন্তু এই জিনিসটা অনেক বেড়েছে। প্রায় প্রতিটা ঘরে ঘরে দেখা যায় নারীরা কর্মক্ষম হচ্ছে। বাইরে কাজ করছে। শিক্ষিত নারী যারা রয়েছে, তারা সমাজে প্রভাব ফেলতে পারছে। একইভাবে রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছেন।
তবে আমি মনে করি নারীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে একজন নারীর যেমন ভূমিকা থাকে, তেমনি একজন পুরুষের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। একটি পরিবারে মেয়ে সন্তানকে এগিয়ে নিতে হলে তার বাবার ভূমিকা থাকতে হবে, ভাইয়ের ভূমিকা থাকতে হবে।
একজন বাবা বা ভাই তার কন্যা সন্তান বা বোনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে শিক্ষিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য, সহযোগিতা ও স্বাধীনতা দিলে কাজটি সুন্দরভাবে মেয়েটি সম্পন্ন করতে পারে। সাহায্যটা কিন্তু প্রথমে পরিবার থেকেই হয়।
একই সঙ্গে একজন নারী কাজে গেলে পুরুষ সহকর্মীটিকেও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক পুরুষ সহকর্মী ভাবেন, নারীটি বোধহয় কাজটি নারী হওয়ার কারণে অন্যভাবেই বাগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সে যে যোগ্যতা দিয়েও কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারা মানতে চায় না। যেই নারী যোগ্য, তার কাজে বাধার সৃষ্টি না করে তাদের সহযোগিতা করুন এবং তাদের প্রসংশা করুন।
একই সঙ্গে একজন নারীরও উচিত অন্য নারীর প্রতি সহমর্মী হওয়া। নারী যেন নারীর পাশে দাঁড়ায়। আমার কাছে মনে হয়, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে নারী-পুুরুষ উভয়েরই একে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই পরিবর্তন হবে গোটা সমাজের।

২. শিরিন আকতার
নাট্য ও সংস্কৃতি কর্মী;
সহ সাধারণ সম্পাদক উদীচি, গাইবান্ধা
আমি নারী ও পুরুষ উভয়কেই বলব জীবন যুদ্ধে বাঁচার লড়াইয়ে লড়াকু সকল নারীর প্রতি একটু শ্রদ্ধা আর সন্মান করতে শিখুন। তাদের প্রতি সহিংসতা থেকে বিরত থাকুন।
নারীর প্রাপ্য সন্মানটুকু দিতে সকলের মনটা প্রসারিত করুন। কারও ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণ করে অসম্মান ও অবহেলার প্রবণতা থেকে সরে আসুন।
এখনো প্রান্তিক অঞ্চলে নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়। এমনকি বৃদ্ধারাও বাদ যায় না। গণমাধ্যেম আমাদের যা দেখায় আমরা সেটুকুই দেখি। কিন্তু সবটা দেখতে পাই না। সবখানে পৌঁছাতে পারে না গণমাধ্যম। তাই আমি বলব, মেয়েদের শরীরকে মাংসপিণ্ড না ভেবে মানুষ ভাবুন সবাই। সেই বোধটা জাগ্রত হোক সকলের মধ্যে। নারী কারও সম্পত্তি না। সহজ সরল বোনেরা মায়েরা সচেতন নারী হয়ে উঠুন।
স্যালুট জানাই সেইসব অবহেলিত লাঞ্চিত মা বোনদের প্রতি যারা ঘুরে দাড়িয়ে বাঁচতে শিখেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে মেয়েরা ঘুরে দাঁড়াবেই। এমন দৃষ্টান্ত অনেক এ দেশে অনেক রয়েছে। তাই নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করুন।
একটা কথা সব নারীকে বারবার করে বলবো, ‘জাগো জাগো জাগো জাগো, কন্যা- মাতা- ভগ্নী।’ নিজের অধিকার বুঝে নিতে সচেতন হওয়া এবং লেখাপড়ার বিকল্প নেই। নিজের জন্য নিজেকে শক্তভাবে তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া নারীমুক্তির আর কোনো বিকল্প নেই।

৩. ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন
ডার্মটোলজিস্ট, রিজুভা ওয়েলনেস
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন নারীদের অর্জন তো প্রতিদিনই, তাহলে বিশেষ একটি দিন কেনো? আমি বলে রাখছি যে আমরা যারা নারী, আমাদের অগ্রগতি, সমাজে অবদান এবং সেটি পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, কর্মক্ষেত্রে ও বৈশ্বিকভাবে- যাইহোক না কেনো এটার প্রশংসা আমরা রোজই করব। সেটা ঘর থেকেও হতে পারে, আমি যেখানে কাজ করছি সেখান থেকেও হতে পারে অথবা আমি যেখানে পড়ালেখা করছি সেখান থেকেও হতে পারে।
কিন্তু সেলিব্রেশন বা উদযাপনের জন্য একটা বিশেষ দিন বেছে নেওয়া হয় সেটা মার্চের মাসের আট তারিখ। একেকটা প্রতিষ্ঠান একেকভাবে সেলিব্রেট করে। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য থাকে। যেমন, ইন্সপায়ারিং চেইঞ্জেস, মেক ইট হ্যাপেন, বি বোল্ড ফল চেইঞ্জেস, প্রেস ফর প্রোগ্রেস। থিম যাইহোক না কেনো নারীর জন্য একটি সুন্দর সুস্থ পৃথিবী প্রয়োজন, যেখানে নারী তাঁর সম্মান নিয়ে বাঁচবে, তাঁর অধিকার নিয়ে বাঁচবে; কথা সে বলতে পারবে স্বাধীনভাবে।
এই যে নারীকে সম্মান দেওয়া বা স্পেশাল অ্যাপ্রিসিয়েশনের জন্য প্রতিবছর এই দিনটা পালন করা হয়, এটার দরকার রয়েছে। শুধু নারীরাই নয় পুরুষরাও তাদের সমানভাবে সম্মান করে সাহায্য করে। নারী ও পুরুষ যৌথভাবে দলগত হয়ে কাজ করলেই সুন্দর একটা পৃথিবী তৈরি হবে।

৪. শ্রাবণী জলি
উদ্যেক্তা, ট্রিভো
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি চাই আরো বেশি বেশি নারী এই কাজে এগিয়ে আসুক। নারীরা তো সংগ্রাম করছেই। এর মধ্যেই ছোটখাটো যে কাজটা সে পারে, যে গুণটা তাঁর রয়েছে সেটার মাধ্যমেই নিজেকে জানান দিক। নিজেকে মেলে ধরুক। বাইরে অন্তত পা রাখুক।
পুরুষ অনেক সময় ব্যাঙ্গ করে বলেন, ‘নারী দিবস! এই একটা দিনই তো তোমাদের, সেলিব্রেট করে নাও আমাদের কোনো দিবস লাগে না।’ আসলে একটা দিন আমাদের নয়। আমরা যেমন জন্মদিন উৎযাপন করি, সামনের দিনগুলো ভালো কাটে যেমন তেমন প্রত্যাশায় চলার পাথেয় সঞ্চার করে নারী দিবস। আমরা নিজেদের সংগ্রাম স্বপ্ন এগুলোকে আবার রিনিউ করতে পারে এমন একটা দিবস আমাদের সেই শক্তি সঞ্চার করে কোনো না কোনোভাবে অনুপ্রেরণা দেয়।

৫. ডা. সানজিদা হোসাইন পাপিয়া
ডেনটিস্ট ও প্রোগরাম প্রেজেন্টার
বাংলাদেশের নারীরা এখনো শিক্ষার জায়গায় পিছিয়ে রয়েছে। এখনও অনেক নারী স্বশিক্ষায় বা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। আমার মনে হয় সে জায়গাটাতে একটু নজর দিতে হবে। আরেকটা জায়গায় নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। সেটি হচ্ছে বোধের জায়গা। বোধ বলছি এ কারণে, অনেক শিক্ষিত নারী রয়েছে যারা এখনও তাদের অধিকার আদায়ের যে বিষয়টা কিংবা তাদের আত্মসম্মান রক্ষার যে বিষয়টা সেই জায়গাটা বুঝতে পারে না। এখনও অনেক শিক্ষিত নারীকে আমরা দেখি অসম্মানিত হচ্ছে তাঁর পরিবারে ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। তারপরও কিছু বলছে না, মুখ বুজে সহ্য করছে। আমি বলবো, এই জায়গাটিতে তারা পিছিয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের অসহায় ভাবছে। তারা বুঝতে পারছে না যে কোথায় আসলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এসব বিষয়ে আরো ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি।
নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। পাশাপাশি বোধের জায়গাটিও শাণিত করবে সে। তাহলে মানুষ হিসেবে নিজেকে আরো উন্নত করতে পারবে। আসলে নারীর ভেতরের আত্মবিশ্বাসকে সম্মান দিতে হবে। নারী নিজেকে সম্মান দিলে অন্যরা সম্মান দেবে। এইটুকুই মাথায় রাখা চাই।
নারী-পুরুষ সবার জন্যই একটা ছোট্ট বার্তা- নারী নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করুন। আর পুরুষরা অবশ্যই তাদের পাশে থাকুন ৷ তাদের সহযোগিতা করতে না পারলেও, অন্তত বাধা দেবেন না। তারা যখন ভালো কাজ করবে, নিজেদের একটা ভালাে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তখন আপনার পরিবার, আপনার সন্তান এবং আপনি নিজেও সবদিক থেকে সমৃদ্ধ হবেন।