সাতকাহন২৪.কম ডেস্ক
নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে অনেক সংগ্রামের কথা উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসে। সেইসব প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রেখে বর্তমানের দিকে তাকালে, এই সময়ে এসে নারী কতটা বৈষম্যহীন কর্মক্ষেত্র পাচ্ছে? চলার পথ তাদের কতটা বন্ধুর বা মসৃণ? এসব ভাবনাই আমরা তুলে ধরছি সাতকাহনের পাতায়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর ভাবনা নিয়ে দুই পর্বের এই লেখায় আজ শেষ পর্ব।
৬. আফরোজা পারভীন
বিউটি এক্সপার্ট, স্বত্বাধাকারী রেড, সহ প্রতিষ্ঠাতা উজ্জ্বলা
মেয়েদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত থাকা উচিত। মেয়েদের শক্তিশালী হওয়া জরুরি। যতই মেয়েদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত থাকবে, তাকে বড় ধরনের ঝড়ও উপড়ে ফেলতে পারবে না, তখন মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। পায়ের নিচের মাটি শক্ত থাকলে, সে যা চায়, তার সংসার, পরিবার, জীবন- সব গোছাতে পারবে। এর জন্য দরকার শিক্ষা ও কাজ। শিক্ষাতো সরকার দিয়েই যাচ্ছে। সেই সুযোগটা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি অবশ্যই কাজ করা উচিত। কাজ করলে ভিত শক্ত হবে। তাহলে যতই ঝড় আসুক মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
সন্তানও এক সময় আমাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে। আমার হয়তো মনে হতে পারে, আমি উঠে দাঁড়াতে না পারলে সন্তান তো রয়েছে। তবে এমন তো হতেই পারে, আমার সন্তানের মানসিকতা বদলে গেলো। সে হয়তো আমাকে দেখতেই চাইলো না বা সে হয়তো পারছে না। চাইছে কিন্তু পারছে না। তখন কি আমি আমার বাচ্চার ওপর বোঝা হয়ে যাবো ? সেটা হওয়া উচিত নয়।
একটা ছেলে যদি জন্মের পর থেকে ভেবে বড় হয়, আমাকে কাজ করতে হবে; আমাকে ‘শো রান’ করতে হবে, তাহলে একজন মেয়ে কেন জন্মের পর থেকে ভাবতে পারে না, আমাকে ‘শো রান’ করতে হবে ? মেয়েরা ভাবে না। কারণ, মেয়েদের বড় হওয়ার সময়টাতে পরিবার তার মাথায় ভুল ধারণা দিতে থাকে। বলতে থাকে, তুমি তো শ্বশুড় বাড়ি যাবে, তুমি তো বিয়ে করবে। একটা ভালো রেজাল্ট করো, ভালো বিয়ের জন্য। বুলশিট কথাবার্তা এগুলো। ভালো ফলাফল করতে হবে, কারণ তোমাকে একটি সম্মানজনক পজিশনে কাজ করতে হবে। সেটার জন্য। বিয়ের জন্য নয়। একটি ছেলেও তো কাজ করছে, সে বিয়ে করছে না ? তাহলে একটি মেয়েকে কেন শুধুমাত্র বিয়ে করার জন্যই পড়াশোনা করতে হবে? এটা হওয়া উচিত নয়। এ কারণে, আমার মনে হয় শিক্ষা ও কাজ-দুটো করতে হবে। আর আমার মনের শক্তি তখনই থাকবে, যখন আমার কাছে এ দুটো থাকবে।
৭. সৈয়দা সানজিদা মহসিন
উপ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বেশি। নারী সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক কিছুতে পিছিয়ে পড়ে। বিশেষ করে যাদের ছোট সন্তান, তাদের বাইরের কাজ রেখে সন্তান-সংসার দেখতে হয়। এ ছাড়া ইদানিং দায়িত্বশীল গৃহকর্মী না পাওয়ায় অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেয়। অনেকে পরিবারের মানুষের সহযোগিতা পায় না।
নারীর এগিয়ে যেতে হলে সবার আগে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। নিজের পছন্দমতো জায়গা খুঁজে সেখানে ক্যারিয়ার বানানোর জন্য পরিবার থেকে সাহায্য করতে হবে।পড়াশুনা চলমান থাকাকালীন নিজে যে সেক্টরে কাজ করবে সে বিষয়ে আইডিয়া নিয়ে এগুনো জরুরি।
পরিবর্তনশীল পৃথিবীটাতে টিকে থাকলে হলে নারীর পুরুষকে বুঝতে হবে, পুরুষেরও নারীকে বুঝতে হবে। এরা একে অপরের পরিপূরক। কেউ কাউকে ছেড়ে নয়। দায়িত্বগুলো নারী-পুরুষ মিলে করলেই পরিবার শান্তিপূর্ণ থাকবে।
৮. আঁখি ভদ্র
স্বত্ত্বাধিকারী, ট্রিভো ফ্যাশন হাউজ।
নারীর আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। অতি আত্মবিশ্বাসের কথা বলছি না। তবে নিজের ওপর আস্থাটা থাকতে হবে। আমার সেই আত্মবিশ্বাসকে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারলেই নতুন কিছু পাবো।
আমি দীর্ঘ ১২ বছর একটা জায়গায় চাকরি করেছি। আমি তখন মনে করেছি এটাই আমার জায়গা। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করেছি। এরপর মনে হয়েছে ব্যবসা করব। এখন আমি ব্যবসা শুরু করেছি। শ্রাবণী জলি ও আমি দুজন মিলে উদ্যোগটা নিয়েছিলাম দুই বছর আগে। আমাদের যে অনেক টাকা ছিল, স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল, সেটা নয়। আমাদের অনেক মানুষ চিনতোও না। আমাদের যা ছিল সেটা, আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই বোধহয় অনেকের কাছেই এখন পৌঁছাতে পেরেছি।
আমি যদি মনে করি ‘আমি পারবো না বা আমাকে করতে দেবে না, সহযোগিতা নাই কীভাবে করব?’ এমন ভেবে বসে থাকলে হবে না। আসলে কেউ কিছু করতে দেয় না বা দেবে না, করে ফেলতে হয়। নিজেকেই করতে হবে। আত্মবিশ্বাসটাই মূলকথা এবং আত্মবিশ্বাসই শেষ কথা।
এখন দেখা যায়, অনেক নারী উদ্যোক্তা হতে নিজের উদ্যোগ নিয়ে নেমে পড়ে। তারা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। তবে সেসব গল্প অন্যের কাছে করতে যাবেন না। ভাঙা বাড়ির শেষের ইটগুলোও মানুষ খুলে নিয়ে যায়। নিজের ভেঙে যাওয়র গল্প কাউকে না বলাই ভালো। আমি পারছি না- এটা না ভেবে শুধুমাত্র নিজেকে বিশ্বাস করে লেগে থাকুন। অন্য কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা করার দরকার নেই। শক্ত হয়ে লেগে থাকতে থাকতে একটা সময় হয়ে যায়। কখনোই গিভ আপ করা যাবে না। লেগে থাকতে থাকতে একদিন দেখবেন অনেক বড় কিছু দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।
৯. নিশাত শারমিন নিশি
পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর ওপর পুরুষের প্রভুত্ব করার বিষয়টি এখনও দেখা যায়। নারীর অধিকার ও সমতা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও বা আলোচনা চললেও বাস্তবিকতা কিন্তু ভিন্ন। নারী দিবসকে ঘিরে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন করা হলে বোধহয় অনেকেই উপকৃত হতো। আমাদের একজন বেগম রোকেয়া ছিলেন, যিনি নারী মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তবে এখন এসে কিন্তু নারীমুক্তির ক্ষেত্রে তেমন করে আমরা কোনো গাইডলাইন পাই না। এখন ২০২৪, এই সময়ে এসে আমাদের স্ট্রাগল করার কথা না। কিন্তু কোয়ালিফাইড হওয়ার পরে সমতা পাবার জন্য আমাদের স্ট্রাগল করতে হচ্ছে। একটা ছেলের ক্ষেত্রে কিন্তু এই বৈষম্যগুলো নেই। নারীদের জন্য কেউ কিছু করতে চাইলে সমতা বিধানের জায়গাটা নিশ্চিত করবে, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম থাকাটা জরুরি।
প্রচলিত একটা ধারণা রয়েছে, একজন নারী, আরেকজন নারীর ভালো চায় না। আমি বলব যে কাজের জায়গায় বা পরিবারে আমরা যেনো পুরুষদের দিয়ে নিজেদের ডমিনেট করার সুযোগ করে না দিই। একে অন্যের পাশে দাঁড়াই। নারীর জন্য সম্মানের জায়গাটা রক্ষা করার জন্য ঐক্যটা থাকা জরুরি।
১০. আলেয়া আক্তার মৌসুমী
কপিরাইটার, এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের গোড়াপত্তনের যে প্রেক্ষাপট সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন যদি শ্রমজীবী নারী পথে না নামতো, তাহলে হয়তো আজ আমি গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে কাজ করতে পারতাম না। হয়ত আমাকেও ঘরেই বসে থাকতে হতো।
আমি যেখানে কাজ করি সে জায়গাটা পুরোপুরি কর্মবান্ধব। নারী বা পুরুষ হিসে আলাদা করে ট্রিট করা হয় না। যে যে যার যার যোগ্যতায় কাজ করে। কিন্তু তারপরেও যেনো নিরাপত্তাহীনতা কোথাও একটা কাজ করেই। অনেক সময় যখন কাজ করতে করতে রাত হয়ে যায়, তখন আমাদের পুরুষ সহকর্মীরা আমাদের আগেই বাসায় ফেরার জন্য তাড়া দেন। কারণ, আমরা নারীরা রাস্তায় কিংবা যানবাহনে এখনো নিরাপদ নই। তারা আমাদের নিরাপদে ঘরে ফেরা নিশ্চিত করতে দ্রুত ঘরে ফিরে যাওয়ার তাড়া দেন। এই ব্যপারটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে ওই যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কিংবা ঘরে ফেরার পথ নারীদের জন্য এখনো নিরাপদ না এটা ভীষণ মন খারাপের একটা ব্যপার।
আমরা ভায়োলেন্স এগেইনেস্ট উইমেন এর ওপর বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালাই। সেখানকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটোরই ডাটা সংগ্রহ করা থাকে। আমরা যখন পর্যালোচনা করি, তখন দেখা যায়, কী পরিমাণ সহিংসতা মূলক মন্তব্য মানুষ করে। এই মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়েই রয়েছে। আমি বলবো, এই ক্যাম্পেইনগুলোর মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার পরিমাণ হয়ত একেবারে কমিয়ে আনা যাবে না। তবে কিছু মানুষের চিন্তাতে অন্তত নাড়া দেওয়া যাবে। আর নেতিবাচক মনোভাব যাদের রয়েছে তাদের চিন্তা বদলানোর জন্যে হয়তো একটা স্টেপ আবার নেওয়া যাবে। একদিনে হয়ত হবে না। তবে এক সময় হয়ে যাবে।
পরিবারের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। যে নারী যেকোনো ধরনের নিপীড়নের শিকার হয় হতে পারে, সেটা বিয়ের পর স্বামীর ঘরে কিংবা রাস্তায় বা যেকোনো কোথাও সে কিন্তু সবচেয়ে আগে পরিবারে বা তার মাকে এসে বলে। তখন মায়েরা আমাদের চুপ থাকতে বলে লোকে জানলে খারাপ বলবে। কিন্তু লোকে খারাপ বলবে ভেবে একজন ভিক্টিমকে যদি চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, তাতে করে এইসমস্ত লোকগুলো আরো বেশি আস্কারা পেয়ে যায়। এগুলো বাড়তেই থাকে।
লোকে কী ভাববে এটা ভাবনা থেকে বেরোতে হবে। নয়ত চুপ থাকতে থাকতে একদিন সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে যাবে এসব। তাই কথা বলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে।
আর এই প্রতিবাদটা আপনার সন্তান, মেয়ে, বোন বা স্ত্রীকে ঘর থেকেই শেখানো শুরু করুন। ওই প্রথম দিন থেকেই মায়েরা যদি চুপ করিয়ে না দিয়ে মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে সাহস যোগান তাহলে একদিন কমে যাবে এইসব অনিরাপত্তার শঙ্কা।