শাশ্বতী মাথিন
বর্তমানে বাংলাদেশের সফল নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ওয়ারেছা খানম প্রীতি। তিনি ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম হার-ই- ট্রেডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি ৭১ ফাউন্ডেশনের জয়েন্ট সেক্রটারি হিসেবে যুক্ত রয়েছেন।
কেবল নিজের উদ্যোগ নয়, অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের পন্যের প্রসার ও প্রতিষ্ঠানের সফলতায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তবে শুরুটা এতো সহজ ছিলো না। অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে, শিকার হতে হয়েছে মানুষের তীর্যক মন্তব্যের। তবুও থামেননি। এগিয়ে যাচ্ছেন নারীর কল্যাণে। নারী দিবসের বিশেষ আয়োজনে তুলে ধরা হলো ওয়ারেছা খানম প্রীতির সঙ্গে কথোপকথনের কিছু মুহূর্ত।
সাতকাহন২৪.কম : আপনার ছোটবেলাটা কেমন ছিলো?
ওয়ারেছা খানম : ছোটবেলা কেটেছে নাটোরে। গ্রামের বাড়িও সেখানেই। আব্বুু চাকরি করতের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে। তবে আমরা থাকতাম, গ্রামে; নাটোর সদর থেকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। আব্বু প্রতিদিন গ্রাম থেকে সেখানে যাতায়াত করতেন। গ্রামের বাড়ির একটি মজা ছিলো। আমি বুদ্ধি হওয়ার আগ পর্যন্ত আব্বু সেখানে একা ছিলেন। আমার দাদা রেলওয়েল বিভাগে চাকরি করতেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূত্রে তাঁর থাকা পরতো। আমার ফুফু, কাকারা- দাদার সঙ্গে থাকতেন। আমার বাবারা অনেক ভাইবোন। আট ভাই, ছয়বোন। প্রথম আব্বুই থাকতেন গ্রামে। আমার বুদ্ধি হওয়ার ঠিক আগেই দাদা অবসরে চলে যান। দাদা সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। এটা খুব আনন্দের একটি বিষয় ছিলো। আমরা যখন, দুপুরে, রাতে খেতে বসতাম- দেখা যেতো, একসঙ্গে ৩০ থেকে ৪০ জন বসে গিয়েছি। আসলে আমি বেড়েই উঠেছি একান্নবর্তী পরিবারে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখেছি এত বড় একটি পরিবার। সেই পরিবারের সৌন্দর্য, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, একাত্মতা- এসবের মধ্যেই আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে। এরপর বাবা যখন বদলি হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন জায়গায় কাটে ছোটবেলা।
আমার প্রাইমারি কেটেছে গ্রামের স্কুলে। তবে পরে নাটোরের সিংরায় এসএসসি, এইচএসসি শেষ হয়। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছি।
সাতকাহন২৪.কম : আপনি তো সাংবাদিকতা করেছেন, লেখালিখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন….
ওয়ারেছা খানম : আসলে আমার পেশা জীবনের বেশিরভাগটাই পত্রিকায় কেটেছে। আমি পত্রিকায় চাকরি করতাম, কন্ট্রিবিউটিং করতাম। বাংলাদেশ২৪, বার্তা ২৪, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের আনন্দআলো-তে কাজ করেছি। এর মাঝে অন্যান্য পত্রিকাতেও লেখালিখি করেছি। আমার ভালো লাগার জায়গা ছিলো লেখালিখি। ভালো লাগাটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। তবে একটা সময় চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করলাম। এর বিভিন্ন উথ্থান-পতন রয়েছে। এটা করতে করতে করোনা চলে এলো। সব থেমে গেলো। এখন পুরোনো সব পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে কাজে নেমেছি।
আমি আসলে কাজের ক্ষেত্রে ভালোলাগাকে বেশি প্রাধান্য দিতাম। তবে এখন যেই কাজটি করি, সেটিই খুব গুরুত্ব দিয়ে করি। একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার জন্য যেই পরিমাণ দক্ষতা প্রয়োজন, সেই জায়গাটি তৈরি হয়েছে।
সাতকাহন২৪.কম : হার-ই- ট্রেড করবার ইচ্ছাটা কেন হয়েছিল? বা কী ভাবনা থেকে এটি করা?
ওয়ারেছা খানম : ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট শুরু হয় হার-ই-ট্রেড। ক্রেতা ও উদ্যোক্তা মিলে বর্তমানে এখানে ৪৮ হাজার সদস্য রয়েছে। হার-ই-ট্রেডের মোট পাঁচটি অফলাইন এক্সিবিশন হয়েছে। এপ্রিলের সাত ও আট তারিখ ৬ষ্ঠ এক্সিবিশন অনুষ্ঠিত হবে। করোনাকালীন নারী উদ্যোক্তাদের পন্যের প্রচার ও প্রসারে এই প্লাটফর্ম তৈরি করা।
হার-ই ট্রেড যখন প্রকাশ্যে আসল, অর্থাৎ যেভাবে আমি কার্যক্রম পরিচালনা করছিলাম, সেটা যখন মানুষের চোখে পড়লো, তখন একটি বিষয় ঘটলো- আমার কাছের কিছু মানুষ যাদের আমি ভাবতাম, তারা নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত, তারাই আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো, কেন আমি গ্রুপটা তৈরি করলাম! আমার গ্রুপ তাদের গ্রুপের কার্যক্রমকে হ্যাম্পার করবে বলে তারা আশঙ্কা করেছে। তাদের এমন মনোভাব আমাকে আহত ও অপ্রস্তুত করেছে। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে নারীদের নিয়ে এই কার্যক্রম চলমান থাকুক। যেই করুক না কেন একজন নারীরও যদি উপকার হয়, উপকারই তো হচ্ছে।
সাতকাহন২৪.কম : বর্তমানে আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কেমন? কী মনে হয় আপনার?
ওয়ারেছা খানম : নারীর পিছিয়ে পড়ার কারণে আসলে অনেক। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, পারিবারিক সবাই দায়ী। আমাদের সমাজ সবসময় কমপ্রোমাইজ বা আপসের জায়গাটায় নারীকে বসিয়ে দেয়। নারী কেন সবকিছুতেই আপস করবে? আপসের জায়গা শুধু আমার নয়। কমপ্রোমাইজের জায়গায় পুরুষও থাকতে পারে, পরিবারও থাকতে পারে, রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব থাকতে পারে। এই কথাগুলো জোড়ালোভাবে বলতে হবে। তবে যখন উর্ব্ধতন অবস্থানে থেকে নারী এসব জায়গায় হাত দেওয়ার সুযোগ পাবে, সবাই তখন সেই সুবিধা ভোগ করবে। নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের জন্য কয়েকজন নারীকে অন্তত এই পর্যায়ে পৌঁছতে হবে।
সাতকাহন২৪.কম : নারী দিবসে, নারীর অগ্রগতীর জন্য আপনার পরামর্শ?
ওয়ারেছা খানম : নারী যেন নিজেকে মানুষ মনে করে। নারী যখন নিজেকে মানুষ মনে করবে তখন সে অধিকার সচেতন হবে। অধিকার সচেতন হলে সেই নারী শক্তিশালী হবে। আমাদের একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত। নারীর যেন সবকিছুর প্রতি দায়। তাকে সবকিছুতেই দক্ষ হতে হবে। এটি করতে গিয়ে নারীরা নিজেকে হারিয়ে ফেলে সমাজের ভেতর, পরিবারের ভেতর। এখান থেকে সে বের হতে পারে না। তাকে নিয়মের মধ্যে, ছকের ভেতর ফেলে দেয় সমাজ। এই কাজগুলো নারীর, আর এই কাজগুলো পুরুষের। সুতরাং নারীকে ওই কাজের ভেতরই থাকতে হবে। নারী যখন নিজেকে মানুষ মনে করবে, তখন বুঝতে পারবে সবকিছুর দায় তার নয়। প্রত্যেকে নিপুণভাবে সবকিছু করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মে না। লক্ষীমন্ত নারী, সতী নারী- এইসব শব্দচয়ন করে নারীকে আটকে রাখা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আসলে বের হয়ে আসতে হবে। সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার মতো মানসিক সক্ষমতা থাকতে হবে। সে শুধু একজন নারী নয়, সে একজন মানুষ।