শাশ্বতী মাথিন
‘আস্সালামু আলাইকুম। মোহসেনা শাওন আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি এনটিভির দুপুরের খবরে।’- টেলিভিশনের পর্দা খুলে সংবাদ দেখতে গেলে এভাবেই যেই মানুষটির সুন্দর মুখশ্রী প্রায়ই সামনে ভেসে উঠে তিনি মোহসেনা শাওন। দর্শকদের কাছে তিনি হাজির হন দেশ-বিদেশের নানা খরবের ঝুলি নিয়ে। কখনো সেই খবরে থাকে আনন্দ, কখনো শোক। নিজের আবেগকে সংযত করে দর্শকদের জানিয়ে যান সেই সংবাদ।
মোহসেনা শাওন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন সংবাদ উপস্থাপনার সঙ্গে। শুরুতে মাইটিভি, এরপর এটিএন নিউজে কাজ করেন। বর্তমানে এনটিভির সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্সটিটিউটে সংবাদ উপস্থাপনার কোর্স করাচ্ছেন।
টেলিভিশনের পর্দায় যেই মানুষটির হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব দেখলে আমরা আনন্দিত হই, তার জীবন কিন্তু এতোটা সহজ ছিল না। গায়ের রং কালো হওয়ার জন্য শুনতে হয়েছে অনেক কটু কথা। নোংরা ইঙ্গিতও পেতে হয়েছে। কখনো কখনো কাজ করতে গিয়ে ভীষণভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বিষণ্ণতায় ভুগেছেন, কেঁদেছেন। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছেন মোহসেনা শাওন; বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংবাদ উপস্থাপক। সাতকাহন২৪.কম-এর নারী দিবসের বিশেষ আয়োজনে রইল মোহসেনা শাওনের চড়াই-উৎড়াইয়ের গল্প।
ছোটবেলাটা খুব আনন্দময় ছিল
আমার ছোটবেলা খুব আনন্দময় ছিল। চট্টগ্রাম শহরে বড় হয়েছি। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার চাকরিসূত্রে পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। এ কারণে আমার জন্ম ও বড় হওয়া চট্টগ্রামে। আমার স্কুল জীবন এখনকার বাচ্চাদের মতো এতো কঠিন ছিল না। এখনকার বাচ্চারা যেমন বাইরে খেলতে যেতে পারে না, সারাক্ষণ গেজেট নিয়ে পড়ে থাকে, আমাদের সময়টা তেমন ছিল না। স্কুলের পর আমরা যে সময় পেতাম বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারতাম। মাঠে যেতে পারতাম, খেলতে পারতাম, গাছে উঠতে পারতাম- এগুলো এখন আসলেই নেই। আমি বলব, অনেক মধুর একটা শৈশব কাটিয়েছি। সুন্দর একটি শহরে বড় হয়েছি, পাহাড়-সমুদ্রের মাঝে, সেটার একটা আনন্দও আসলে ছিল।
আমার স্কুলে একটি সংগঠন ছিল, ‘হলদে পাখি’ নামে। এর সদস্য ছিলাম। অনুষ্ঠান অরগানাইজ করতাম, অংশগ্রহণ করতাম। স্কুলে ও কলেজে থাকার সময় চট্টগ্রামের পত্রিকা পূর্বকোণ, দৈনিক আজাদী-তে লেখা দিতাম। গার্লস গাইড করেছি, স্কাউট করেছি, মঞ্চনাটক করেছি, আবৃত্তি করেছি। সংস্কৃতিক দিকের প্রতি একটি ভীষণ দুর্বলতা ছিল।
আমার লেখাপড়া পুরোটাই চট্টগ্রামে। এসএসসি, এইচএসসি শেষ করার পর জিওগ্রাফি অ্যান্ড ইনভারোনমেন্টাল সাইন্স থেকে গ্রেজুয়েশন করি। সেটিও চট্টগ্রাম থেকেই।
আমার পেশার শুরুতে কয়েকটি জায়গায় করেছি। বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানিতে পাবলিক রিলেশনের কাজ করি। তবে সেটা কখনো দীর্ঘমেয়াদি ছিল না। সংবাদ উপস্থপনার জায়গাটিতে আমি দীর্ঘ ১৫ বছর রয়েছি এবং এখন এটিই আমার একমাত্র পেশা।
মায়ের মৃত্যুর পর বিষণ্ণতায় পড়ি
জীবনের শুরু থেকেই যে সংবাদ উপস্থাপনা করতে চাইতাম, বিষয়টি তেমন নয়। পড়াশোনা শেষ করার আগে আগেই আমার বিয়ে হয়, সন্তানের জন্ম হয়। লেখাপড়া শেষ করার পর ভাবছিলাম কী করবো? এর মধ্যে আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে যান। তিনি ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর অসুস্থ থাকার পরে মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর ছোট ভাই-বোনদের ঢাকায় নিয়ে আসি। মায়ের মৃত্যুর পর মারাত্মক বিষণ্ণতায় চলে যাই। এরপর একজন মনোবিশেষজ্ঞ আমাকে চাকরি করার পরামর্শ দেন।
এরপর একটি বড় মাল্টিনেশনাল কোম্পানিতে যোগ দিই। তবে সেখানে ভালো লাগছিল না। আর মনে হতো বাচ্চাটাকে বাসায় রেখে এসছি। বাচ্চাকে কে দেখবে? মন বসছিলো না কাজে। এরপর মনে হলো সংবাদ উপস্থাপনার কাজটিতো আমি করতে পারি। সংবাদ দেখতাম নিয়মিত। আমার আম্মা খবর দেখতেন। এই জায়গাটি আমারও ভালো লাগতো। আর তখনো পর্যন্ত এই কাজটি ফুল টাইম ছিল না। তাই, এটি করলে আমি পরিবারকেও সময় দিতে পারবো, কাজও করতে পারবো- এটা ভেবেছিলাম।
সংবাদ উপস্থাপক হতে হলে অবশ্যই ‘নিউজ ম্যান’ হতে হবে
যখন সিদ্ধান্ত নিলাম সংবাদ উপস্থাপক হবো, তখন বেশি করে খবর শোনা শুরু করলাম। সংবাদ জানার চেষ্টা করতাম। প্রতিদিন সংবাদ পড়তাম। রেডিওর খবর শুনতাম, টিভির খবর দেখতাম। বাচ্চাকে হয়তো কোচিংয়ে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে বসে খবর পড়তাম। পত্রিকা ব্যাগে করে নিয়ে যেতাম। নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। নিউজ পড়ে মোবাইলে রেকর্ড করে বাসার সবাইকে শোনাতাম। অনেকে প্রশংসা করছিল, ‘তোমার ভয়েজ ভালো, উচ্চারণ ভালো- এই কাজটি করতে পারো।’ এরপর সিভি রেডি করলাম। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে সব জায়গায় সিভি দিলাম।
১৫ বছর ধরে সংবাদ উপস্থাপনার কাজ করছি। আমি যাদের শেখাই তাদের বলি, সংবাদ উপস্থাপক হতে হলে প্রথমে নিউজ ম্যান হতে হবে। সমস্ত সংবাদ জানতে হবে। সংবাদের ভেতরে থাকতে হবে। আপডেট থাকতে হবে। স্মার্ট হতে হবে। শুধু মাত্র সেটা পোশাকে নয়, কথা-বার্তা, চলন-বলন-সবকিছুতেই। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে দীর্ঘক্ষণ টেলিভিশনে কেন দেখবে? একজন উপস্থাপকে অবশ্যই দর্শককে আটকে রাখার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে।
নতুন যারা এই পেশায় আসছে, তাদের একটি কথা বলতে চাই, এখন অনেকেই রয়েছে খুব তাড়াহুড়ো করে উপরে উঠতে চায়। আমি মনে করি, দ্রুত পথ পার হলে সেটা কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। অস্থির হওয়া যাবে না। মনোবলকে শক্ত রেখে এগিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য একদিন পূরণ হবেই। আসলে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
কালো, মোটা এসব নিয়ে কর্মক্ষেত্রে বাজে কথা শুনেছি
কালো, মোটা এসব নিয়ে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। তবে সেগুলো মেধা দিয়ে ওভারকাম করেছি। অনেকের চেয়ে ভালো করছি, তখন এসব বিষয় এড়ানো গেছে। এই পেশায় কাজ করতে গেলে অনেকেরই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। দেখা যায়, অনেকে বাজে মন্তব্য করে। মিডিয়ার মেয়ে মানে ভালো না। এদের হয়তো সহজে পাওয়া যায়, এমন মনে করে। এসব বিষয় শক্তভাবে ওভারকাম করতে হয়েছে।
নারীকে এগোতে হলে মন-মানসিকতায় শিক্ষিত হতে হবে
একজন নারী সামনে এগোতে চাইলে প্রথমে তাকে শিক্ষিত হতে হবে। লেখাপড়ার শিক্ষায় কেবল শিক্ষিত নয়, মননে, সংস্কৃতিতে, মেধায় শিক্ষিত হতে হবে। তার চিন্তা-চেতনাকে অনেক উৎকর্ষে নেওয়া চাই। প্রগতিশীল হতে হবে। আমি যতই শিক্ষিত হই, কিন্তু সংকীর্ণমনা হলে কখনোই শিক্ষিত হতে পারবো না। নারীর জন্য শিক্ষিত হওয়াটা খুব জরুরি। তিনি যদি বাইরে কোনো কাজও না করেন, ঘরেও যদি শিক্ষিত হন, তাও সেটি সংসারের মানুষকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
আমি মনে করি, ২০ থেকে ২৫ বছর আগের তুলনায়ও নারীরা অনেক এগিয়েছে। তবে অনেক এগোনোর পরও কোথায় যেন পিছিয়ে রয়েছে। এইচএসসি, এসএসসিতে মেয়েদের ভালো করার হার বেশি। মেয়েরা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাচ্ছে বেশি। সব জায়গায় মেয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরও কোথাও গিয়ে যেনো এগোতে পারে না। সংসার সামলাতে হবে ভেবে নারীকে পিছিয়ে রাখা হয়। নারী তার ক্যারিয়ারের অনেক উচ্চ শিখরে যেতে পারে না কেবল সংসারের চিন্তা করে। আসলে নারী-পুরুষ উভয়কেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে।
পাশাপাশি নারীর জন্য কাজের জায়গা নিরাপদ হওয়া দরকার। মেধা থাকার পরও কেবল নারী বলে অনেকেই বাধার সম্মুখিন হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে সহিংসতার শিকার হয়। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। পুরুষ যেমন নির্বিঘ্নে কাজে যায়, একজন নারীর ক্ষেত্রেও সেই সুযোগটা থাকা জরুরি। এইসব বৈষম্য ঠিক করতে হবে। অনেক শিক্ষিত হওয়ার পরও নারীরা এখনো নিরাপদ নয়।
আবার নারীরাও অনেক সময় নারীবান্ধব নয়। নারীর প্রতি নারীরও সহমর্মী হওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। তাহলে হয়তো সমস্যাগুলো অতিক্রম করা যাবে।