উজ্জ্বলা লিমিটেড, বাংলাদেশের বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রিতে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। নারীকে যোগ্য করে তুলতে অনলাইন ও অফলাইন ক্লাসের মাধ্যমে বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিংয়ের সব খুঁটিনাটি শেখানো হয় এখানে। উজ্জ্বলায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং সংগ্রাম করে সাফল্য অর্জন করেছেন, এমন কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে সাতকাহনের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজ রইল ৪র্থ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাশ্বতী মাথিন।
পর্ব ৪ : সোনিয়া খান
ছোটবেলা থেকেইে মেয়েটি চেয়েছিলো স্বনামধন্য হবে। হাউজ ওয়াইফ হয়ে জীবন পার করে দিবে না। নিজে কিছু করে সমাজে শক্তভাবে জায়গা করে নেবে। আর সেই লক্ষ্যেই কাজ করা। বিউটিফিকেশনের উপর বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নিজেই শেখাচ্ছে অন্য শিক্ষার্থীদের। উজ্জ্বলার ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে কাজ করছে ২০২০ সাল থেকে। এ পর্যন্ত তার হাত ধরে বের হয়েছে শত শত শিক্ষার্থী। তৈরি করেছে নিজের বিউটি স্টুডিও। যার কথা বলছি, তিনি সোনিয়া খান। নিজের জীবনযুদ্ধ ও পথচলার কথা জানি তার মুখ থেকে।
পুরুষের আধপিত্তশীল চরিত্র নিতে পারতাম না
ছােটবলোয় ইচ্ছা ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনার হবাে। বাসায় জানানাের পর বলল, ‘ডিজাইনার (নকশা) তাে ভালাে লাগে, তবে ফ্যাশন শুনলইে তাে আর ভালাে লাগে না।’ আমি একজনকে পছন্দ করতাম। বাসা থেকে রাজি ছিলো না তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য। পরে আমরা নিজেরাই বিয়ে করি। দুই বছর বাবা কােনাে যােগাযােগ করেননি। পরে সন্তান হওয়ার পর যােগাযােগ করে।
সংসাররে শুরুতে স্বামীর আয় কম ছিলো। তখন মনে হলাে নিজেকে সাহায্যরে জন্য কছিু করি। কিছু জায়গায় মনে হয়েছে আমি অসহায়। আয় করা দরকার। তখন এলাকার একটি র্পালারে কাজ শিখি। কাজ শেখার পর পার্লার দিতে চাইলাম। বাপরে বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি সব জায়গা থেকে মানা করলাে। এটা তাদের কাছে অনকে ছােট ব্যবসা। তবে সম্মতি দিলেন আমার শ্বশুর। তিনি আমাকে পার্লার খুলতে সাহায্য করলেন। ২০০৭ সালে আমি প্রথম মা হই। ২০০৮ সালের জুনে প্রথম পার্লার দিই। সবসময় ভেতরে একটি ইচ্ছে ছিলো স্বনামে প্রতষ্ঠিতি হবাে। হাউজ ওয়াইফ হয়ে জীবন পার করে দেবো না। ছােটবেলা থকেইে আমি পুরুষের ডমিনেটিং (আধপিত্তশীল) চরিত্র নিতে পারতাম না। পার্লারের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করি। ব্লক, অ্যামব্রয়ডারি করে বিক্রি করতাম। ২০১০ সালে আমি আবার গর্ভধারণ করি। তখন পার্লারে কম যেতাম। পার্লারের মেয়েরা ঠিকমতো কাজ করতো না। আমার স্বামী বলতো, ‘সংসারের দিকে মনোযোগ দাও। চাকরি করো, ব্যবসা ছেড়ে।’ কিন্তু আমি তাদের বোঝাতে পারতাম না যে নিজের ব্যবসা করে পরিবারকে আমার সুবিধামতো সময় দিতে পারি। এটা চাকরি করে সম্ভব নয়।
২০১১ সালে আমার বাবা মারা যান। এটা ছিলো আমার জন্য একটি বড় আঘাত। মা-ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। মায়ের অসুস্থতা, সন্তান মানুষ করা, আমার লেখা-পড়া মিলিয়ে পার্লার চালাতে বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল পার্লারের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তখন সাময়িকভাবে পার্লার বন্ধ করে দিই। আসলে আমি এমন একটা মেয়ে যে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই চায়। আর প্রয়োজন পড়লেই চায়। নিজের হাত খরচের জন্য অন্যের কাছে টাকা চাইতে অস্বস্তি লাগতো। পার্লার চালিয়ে আয় হওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে একটা ভীষণ শূন্যতা তৈরি হলো।
‘মৃত্যু আসলেও তাকে থামিয়ে দিয়ে লেখা-পড়া করতে হবে’
এর মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাই। সংসারের ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে পড়ে একটা সময় মনে হয়েছিলো পড়া বন্ধ করে দিবো। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আমাদের আত্মীয় ছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু আসলেও তাকে থামিয়ে দিয়ে লেখা-পড়া করতে হবে। লেখা-পড়া থামানো যাবে না।’ তিনি আমাকে এই ক্ষেত্রে অনেক সহযোগিতা করেন।
এর মধ্যে আবার ফ্যাশন জিজাইনিংয়ে ভর্তি হই। ছোটবেলার স্বপ্নকে পূরণ করতে চাই। পাশাপাশি আরো অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য বিউটিফিকেশনের উপর বিভিন্ন কোর্স করতে থাকি। এ সময় পরিচিত হই উজ্জ্বলার সহপ্রতিষ্ঠাতা আফরোজা পারভীন আপার সঙ্গে। তাঁকে বলি, আরো শিখতে চাই। তিনি জানান উজ্জ্বলা নামে একটি প্রতিষ্ঠান আসছে যেখানে বিউটিফিকেশনের উপর পেশাদারভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম আমি। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য বিউটি আর্টিস্টদেও কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে থাকি। ২০১৫ সালে আবার নতুন করে পার্লার দিই।
একটা সময় ছিলো সারাদিন কাঁদতাম
পারিবারিক ভীষণ সমস্যা ছিলো আমার। একটা সময় ছিলো মনে হতো পাগল হয়ে যাবো। সারাদিন কাঁদাতাম। একদিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কেঁদেছি। এরপর ভাবলাম যথেষ্ট হয়েছে। ইউটিউব ছেড়ে ধ্যান করলাম। ধীরে ধীরে ধ্যান বা মেডিটেশন করার প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। এটি আমাকে অনেক প্রশান্তি দেয়। আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে মেডিটেশনের কোর্স করি।
উজ্জ্বলা আমাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে
২০১৯ এর শেষের দিকে যখন কোভিড আসে পার্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। খুব বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। তখন উজ্জ্বলার ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগ দিই। উজ্জ্বলা সে সেময় আমাকে অর্থনৈতিভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে। উজ্জ্বলার ব্রাইডাল মেকআপ, হেয়ার কাট, নেইল এক্সটেনশন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ছয় থেকে সাতটি কোর্সের ক্লাস করাই আমি। প্রতিষ্ঠানটি আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে নিজে স্বাবলম্বী হতে হয়, পাশাপাশি আর ১০ জন মানুষকে সাহায্য করতে হয়। আমি সেটি করতে পারছি। এ ক্ষেত্রে নিজেকে একজন ‘উজ্জ্বলা’ মনে করি।
ভবিষ্যতে ইচ্ছে রয়েছে একটি সৃজনশীল স্কুল তৈরির। এখানে সৃজনশীল সব বিষয়ে পাঠদান করা হবে। পাশাপাশি চাই বাংলাদেশের অন্যতম একজন বিউটি আর্টিস্ট হতে। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।