ডা. গুলজার হোসেন উজ্জল
বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। এদের অধিকাংশ বাহকেরা জানতেও পারে না যে তারা বাহক। দুজন বাহকে বিয়ে হয়ে গেলে সর্বনাশ। আশঙ্কা থাকে এদের পঁচিশ শতাংশ বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে, পঞ্চাশ শতাংশ হবে বহনকারী। তবে একজন বাহক আর একজন বাহক নন এমন ব্যক্তির মধ্যে বিয়ে হলে কোনো ভয় নেই।
বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় হাজার বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আগামি পঞ্চাশ বছরে থ্যালাসেমিয়ার রোগী দ্বিগুণ হবে।
থ্যালাসেমিয়া কী?
থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক বিশেষ ধরনের অসুখ। এটা ক্যানসার নয়, ছোঁয়াচেও নয়। থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রোগ। মানুষের শরীরে কোষের ভেতর যে জিন থাকে, সেই জিন এই রোগের বার্তা বহন করে।
আসুন থ্যালাসেমিয়াকে জানি
আমাদের রক্ত কেন লাল? কারণ, আমাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা থাকে। এখানে হিমোগ্লোবিন নামে বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থও থাকে। এই হিমোগ্লোবিনের কাজ কী? হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
থ্যালাসেমিয়া বলে এক ধরনের বংশগত রোগ রয়েছে। এটি শরীরে বিশেষ ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লেবিন তৈরি করে। স্বাভাবিক লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল ১২০ দিন। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে অথবা বলা যায় হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সেখান থেকে দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। এই হলো থ্যালাসেমিয়া।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালাসেমিয়া অনেক রকমের রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনেরও রকমফের ঘটে। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, থ্যালাসেমিয়া প্রধাণত দুই প্রকার। যথা ১. আলফা থ্যালাসেমিয়া। ২. বিটা থ্যালাসেমিয়া।
বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এর উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। বিটা থ্যালাসেমিয়া আবার দুই রকমের হতে পারে। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এদের থ্যালসেমিয়া ট্রেইট বা ক্যারিয়ার বলে। অপরটি মেজর।
থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট আর থ্যালাসেমিয়া এক নয়। কারণ, এরা মূলত রোগটির বাহক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারাজীবন এই রোগ বহন করে চলে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বাবা ও মা উভয়ে থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট হলে ভূমিষ্ঠ শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
উপসর্গ
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গগুলো মূলত রক্তস্বল্পতার কারণে সৃষ্ট উপসর্গ। অর্থাৎ ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, শ্বাসকষ্ট, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এসব। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়ে ত্বক হলদে হয়ে যায়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃতও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থি পাতলা হয়ে যেতে থাকে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়। নাকের হাড় দেবে যায়। মুখের গড়ন হয় চীনাদের মতো। একে বলে ‘মংগোলয়েড ফেইস’। আস্তে আস্তে দেখা দেয় বিশেষ কিছু জটিলতা।
রোগীকে ঘনঘন রক্ত দিতে হয় বলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই আয়রন জমা হয় হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে। এই পর্যায়টি মারাত্মক। দেখা যায়, অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার কারণে অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী মারা যেতে পারে। বারবার রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে রোগীরা সহজেই রক্তবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।