ডা. মো. ফরিদ রায়হান
এই বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি।হাসপাতালগুলোতে এই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। এমন সময় সতর্কতার বিকল্প নেই। তবে সতর্ক থাকতে হলে জানতে হবে ডেঙ্গু সম্পর্কে।
১. ডেঙ্গু কী
ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হয়। সংক্রমিত এডিস (এডিস ইজিপ্টাই) মশার কামড়ে এটি মানুষের দেহে ছড়ায়। রোগটি সাধারণ থেকে জটিল অবস্থায় চলে যেতে পারে।
২. জ্বরের তারতম্য
সাধারণত ডেঙ্গুতে উচ্চ মাত্রায় জ্বর থাকে। জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। এটি থাকে দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত। তবে এখন ডেঙ্গুর লক্ষণে একটু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রার জ্বর না হয়েও অন্যান্য লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।
৩. তীব্র মাথাব্যথা
সাধারণত ডেঙ্গুতে তীব্র মাথাব্যথা হয়। বিশেষ করে রোগী সামনে ও চোখের পেছনে ব্যথার কথা বলে। এটি তীব্র হয় এবং সবসময় থাকে।
৪. চোখের পেছনে ব্যথা
এই জ্বরে চোখের পেছনে তীব্র অস্বস্তি ও ব্যথা অনুভূত হয়। কেউ চাপ দিয়ে ধরে রয়েছে, এমনটা মনে হতে পারে। চোখের নড়াচড়া ব্যথা বাড়িয়ে দেয়।

৫. জয়েন্ট ও পেশি ব্যথা
ডেঙ্গু জ্বরে তীব্র জয়েন্ট ও পেশি ব্যথা থাকে। এই জন্য একে ‘ব্রেকবোন ফিভার’ বলে। ব্যথা দেহের বিভিন্ন জয়েন্ট ও পেশিকে দুর্বল করে তোলে।
৬. অবসন্ন ভাব
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা মাঝে মাঝে অসম্ভব অবসন্নতা ও দুর্বলতায় ভোগে। এটি কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে। এমনটি রোগ সেরে যাওয়ার পরও এই দুর্বলতা কাটতে সময় লাগে।
৭. বমি ও বমি বমি ভাব
অনেকেরই এই সময় বমি বমি ভাব ও বমি হয়। সঙ্গে থাকে অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য। যেহেতু এই কারণে পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ কম হয়, তাই দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

৮. ত্বকের র্যাশ
ডেঙ্গুতে ত্বকে র্যাশ একটি প্রচলিত সমস্যা। সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে দেহে চুলকানিসহ র্যাশ ও ফুসকুড়ি হয়। প্রথমে এটি মুখ, গলা ও বুকে শুরু হয়। আস্তে আস্তে সারা দেহে ছড়ায়।
৯. রক্তক্ষরণ
ডেঙ্গুতে দাঁতের মাড়ির গোঁড়ায়, মাসিকের রাস্তায়, প্রস্রাব বা পায়খানার রাস্তায় রক্তপাত হতে পারে। এটি ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা। ডেঙ্গু হলে এবং এসব লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়তে পারে।
১০. সচেতনতা বাড়ানোর উপায়
ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে সচেতন ও সতর্ক থাকাই অন্যতম উপায়। মানুষকে বেশি করে জানাতে হবে ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায় এবং এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা কী। সচেতন করার জন্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে ওয়ার্কশপ, সেমিনার করা যেতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিয়ম সভার আয়োজন করা যায়। পাশাপাশি পোস্টার, লিফলেট ও ক্ষুদ্র পুস্তিকা তৈরির মাধ্যমে মানুষকে এ বিষয়ে আরো জানাতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা, লোকাল রেডিও, টেলিভিশনে ডেঙ্গুর প্রতিরোধ সম্পর্কে আরো আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
১১. আবদ্ধ জায়গার পানি পরিষ্কার
ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা যেসব জায়গায় জন্মায়, সেগুলো পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখা বেশ জরুরি। বাসা-বাড়ি, অফিস ও এলাকার চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিত্যক্ত টায়ার, গাছের টব, বদ্ধ জলাশয়- কোনো বদ্ধ জায়গা যেখানে পানি দীর্ঘদিন আটকে থাকে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। আগে ডেঙ্গু পরিষ্কার পানিতে জন্মালেও এখন ময়লা পানিতেও এই মশার বিস্তার দেখা যাচ্ছে।

১২. এলাকাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা ও কতৃপক্ষকে সহযোগিতা
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন দল গঠন করে এই বিষয়টি তদারকি করা গেলে ভালো। ডেঙ্গু নিরোধে স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বাস্থ্যবিভাগকে সহযোগিতা করুন। এলাকার কতৃপক্ষকে মশানিরোধক ওষুধ ব্যবহারে আরো উৎসাহী হতে হবে। যেসব জায়গায় ডেঙ্গুর লাভা বেশি ছড়ায় এবং যেসব এলাকা ডেঙ্গুর জন্য বেশি ঝুঁকিপ্রবণ, সেখানে নিয়মিত মশানিরোধ ওষুধ ব্যবহার করা জরুরি।
১৩. ব্যক্তিগত সুরক্ষা
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ঘুমাবার আগে অবশ্যই মশারি টাঙান। ফুল হাতা জামা পরুন। মশা নিরোধক ওষুধ/ ক্রিম গায়ে মাখুন। সম্ভব হলে ঘরে জানালায় নেট লাগিয়ে নিন। এতে মশা কম প্রবেশ করবে।
১৪. পাঠ্য বইয়ে ‘ডেঙ্গু’ বিষয়টির অন্তর্ভুক্তি
স্কুল ও কলেজের পাঠ্য পুস্তকে ডেঙ্গু সম্পর্কিত একটি অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্তি করা যেতে পারে। এতে একজন শিশু ছোট বয়স থেকে বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে। এ ছাড়া অফিসের বিভিন্ন দেয়ালে ডেঙ্গু নিয়ে প্রবন্ধ, প্রতিবেদন টাঙিয়ে রাখা যায়। এতে কর্মীরা সচেতন ও সতর্ক হবে।
১৫. দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা
ডেঙ্গু রোধে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা ভীষণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন, প্রতিরোধ, চিকিৎসার বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী কাজ করতে হবে। না হলে প্রতি বছর বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবে এবং মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ইত্যাদি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু দীর্ঘমেয়াদে প্রতিরোধে সবার এগিয়ে আসার বিকল্প নেই।
১৬. রোগ ব্যবস্থাপনা
ডেঙ্গু জ্বরে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে এবং দেহের তরলের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

১৭. বিশ্রাম
ডেঙ্গুতে রোগী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেহে পানিশূন্যতা দেখা যায়। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং খাবারে তরলের পরিমাণ বাড়ান। এ ক্ষেত্রে মুরগির স্যুপ, স্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে।
১৮. ওষুধ
সাধারণত ব্যথা ও জ্বর কমাতে চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকে। তবে নন-স্ট্যারেয়েডাল অ্যান্টি- ইনফ্লামেটোরি ওষুধ যেমন, এনএসএআইডিএস ও অ্যাসপিরিন রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। যেকোনো ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
১৯. সবসময় পর্যবেক্ষণ
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। রক্তচাপ, প্লাটিলেট কাউন্ট, হেমাটোক্রিটের মাত্রার বাড়া-কমা বা তারতম্যের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
২০. হাসপাতালে কখন নেবেন?
দেহের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণের সমস্যা দেখা দিলে, রক্তচাপ, প্লাটিলেট কাউন্ট, হেমাটোক্রিটের মাত্রা কমে গেলে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে সাধারণত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার মধ্য দিয়ে, দেহে তরলের পরিমাণ বাড়িয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সর্বোপরি ডেঙ্গু মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন হতে হবে।
লেখক :
ডা. মো. ফরিদ রায়হান
নিউরো ও স্পাইনাল সার্জন
কনসালট্যান্ট, নিউরোসার্জারি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
চেম্বার : কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার-৩
১৬৫-১৬৬, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-২২২২৪৬৩৩৮-৪১
মোবাইল : ০১৭৩১-৯৫৬০৩৩