ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
ডেঙ্গু এখন আমাদের দেশে নতুন কোনো অসুখ নয়। এই রোগের প্রকোপ আবারও বাড়ছে। এই রোগের লক্ষণ, ধরন, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে অনেক আলাপ হলেও জনসচেতনতা বাড়েনি তেমন। ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক কমেনি। এই রোগ নিয়ন্ত্রণেও আসেনি।
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ- এই কথা আগেই জেনে গেছি। ভাইরাসটি ছড়ায় মূলত এডিস ইজিপ্টি বলে এক ধরনের মশার মাধ্যমে। এই মশারা আগে পুরোনো বদ্ধ পানিতে বাস করলেও এখন এদের ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ময়লা পানিতেও এদের জন্ম হচ্ছে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
জ্বর
- ডেঙ্গু রোগীর জ্বর সাধারণত হয় আকস্মিক ও ধারাবাহিক (continuous fever) ধরনের। অনেকে মনে করেন ডেঙ্গুতে বোধ হয় উচ্চ মাত্রার জ্বর হয়। কথাটি আংশিক সত্য। ডেঙ্গুতে উচ্চ মাত্রার, নিম্ন মাত্রার, গায়ে গায়ে জ্বর, এমনকি জ্বর নাও থাকতে পারে।
- জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়।
- মাঝে দুই দিন জ্বরবিহীন থাকতে পারে এবং আবার ফিরে আসতে পারে। একে বলে ’স্যাডল ব্যাক ফিভার’।
মাথাব্যথা
• চোখ এবং চোখের কোটরে ব্যথা
• হাড়ে ও মাংসপেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা
• শরীরে লাল দাগ বা র্যাশ। রক্তে প্লেটিলেট বা অনুচক্রিকা কমে গিয়ে এটা হয়।
• শরীর অস্বাভাবিক দুর্বলতা
• বমি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানাও কোনো কোনো সময় হতে পারে
• বিশেষ কোনো লক্ষণ ছাড়াও হতে পারে।
লক্ষণভেদে ডেঙ্গুকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করি।
১. ডেঙ্গু ফিভার
২. হেমোরেজিক ডেঙ্গু
হেমোরেজিক ডেঙ্গুর দুই রকম পরিণতি হতে পারে। সাধারণ হেমোরেজিক ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। সাধারণ ডেঙ্গু ফিভার নিয়ে ভয়ের তেমন কারণ নেই। এটা সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরের মতো নিজে নিজে ঠিক হয়ে যায়। সাধারণ ডেঙ্গু ফিভারেও প্লেটিলেট কমে যেতে পারে এবং র্যাশ বা ত্বকে ছোপ ছোপ লাল দাগ হতে পারে।
প্লেটিলেট কমে গিয়ে র্যাশ বা ত্বকের লাল ছোপ ছোপ দাগের পাশাপাশি বিশেষ ধরনের রক্তক্ষরণ দেখা দিলে তাকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বলে। এই বিশেষ ধরনের রক্তক্ষরণ বলতে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, রক্ত বমি হওয়া ইত্যাদি বোঝায়। সাধারণ হেমোরেজিক ডেঙ্গু নিয়েও আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কারণ নেই।
ডেঙ্গু জ্বরে ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের কারণে শরীরের ইমিউন সিস্টেমের বিশেষ প্রতিক্রিয়ায় রক্তনালির ছিদ্র বড় হয়ে যায়। তখন রক্তনালি থেকে রক্তরস বা প্লাজমা বেরিয়ে আসে। একে বলে প্লাজমা লিকেজ। এই অবস্থায় প্রেশার কমে যায়, পালস দুর্বল হয়ে যায়, ফুসফুস ও পেটে পানি জমে ইত্যাদি। সেইসঙ্গে রক্তের হেমাটোক্রিট বা কোষীয় অংশের অনুপাত বেড়ে যায়। এ অবস্থাটিই মূলত ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা।
তবে সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। প্লাজমা লিকেজের কারণে ডেঙ্গু রোগীর যখন প্রেশার কমে যায়, নাড়ির গতি বেড়ে যায় ও নাড়ি দুর্বল হয়ে যায়, রোগী অচেতন হয়ে যায় বা অস্থির হয়ে যায়, তখন একে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এই অবস্থায় রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। ডেঙ্গুর জটিলতা হিসেবে মস্তিষ্কে ইনফেকশন (এনসেফালোপ্যাথি), জিবিএসসহ জটিল স্নায়ুরোগ ও লিভার ফেইলিউরও হতে পারে। তবে এগুলো খুবই বিরল।
চিকিৎসা
- জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। এসপিরিন, ব্যথার ওষুধ নিষেধ। এগুলো রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে।
- অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না।
- রুচি অনুযায়ী খাবার খাবেন। তবে প্রচুর তাজা ফলের রস, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি খাবেন। বাজারের প্রিজারভেটিভ দেওয়া জুস খাবেন না। প্রতিদিন আড়াই থেকে চার লিটার তরল খেতে হবে এই সময়।
- বাচ্চাদের ঘন ঘন তরল খেতে দেবেন। প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০০ মিলি তরল দিতে হবে। খেতে না পারলে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন পানিশূন্য না হয়ে পড়ে।
- প্লেটিলেট নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হবেন না। এক লাখের নিচে প্লেটিলেট কমে যাওয়া একটি রোগ লক্ষণ মাত্র। সাধারণত ২০ হাজারের নিচে না নামলে রক্তক্ষরণ হয় না, প্লেটিলেটও ভরতে হয় না। হাতের কাছে ডোনার রাখলেই হবে। এই সময় প্রতিদিন একবার প্লেটিলেটের মাত্রা দেখে নেবেন। অধিকাংশ রোগীরই প্লেটিলেট দেওয়া লাগে না। প্লেটিলেট কমে গিয়ে নিজে নিজেই আবার বাড়তে শুরু করে। একবার বাড়তে শুরু করলে তখন আর প্রতিদিন প্লেটিলেট পরীক্ষা করবার প্রয়োজন নেই। আমরা অজ্ঞতাবশত ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে সব মনোযোগ দিয়ে ফেলি এই প্লেটিলেট কাউন্টেই।
- ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের জন্য প্লেটিলেট কমে যাওয়া খুব জরুরি কোনো শর্ত নয়। আসল শর্ত হলো প্লাজমা লিকেজের লক্ষণগুলো। হিমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, নাড়ির গতি দ্রুত ও দুর্বল হয়ে যাওয়া—এগুলোই হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের প্রধান শর্ত।
- ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের চিকিৎসা আইসিইউতে করতে হবে। এটি বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। রোগীকে পুরোপুরি অবজারভেশনে রাখতে হয়। এখানেও মূল চিকিৎসা স্যালাইন। সক্রিয় রক্তক্ষরণ থাকলে প্লেটিলেট এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে রক্তের ভলিউম বাড়ানোর জন্য পুরো রক্তও দিতে হতে পারে।
প্রতিরোধ
- মশার বাসস্থান ধ্বংস করাই হলো প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। বদ্ধ পানির আধারগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। ফ্রিজের পানি, এসির পানি, টবের পানি পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত।
- দিনে মশারি খাটিয়ে ঘুমাতে হবে।
- অ্যারোসল ও অন্যান্য মশক নিধনকারী ব্যবস্থা অবলম্বন করুন।
লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ