ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে ডাক্তার ও রোগী (কোনো কোনো ক্ষেত্রে) উভয়ের ভেতর। অধিকাংশ রোগীর ডেঙ্গু আতঙ্ক গিয়ে ঠেকে মূলত প্লাটিলেট কাউন্টে গিয়ে। প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলেই আতঙ্কিত হয়ে ছুটছেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশায়। কারণ সাধারণের ধারণা, প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যাবে রোগী। মূলত প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধার কাজে নিয়োজিত অনেক উপাদানের একটি। এটি কেটে গেলে বা আঘাত পেলে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
প্লাটিলেট কমে গেলে শুরুতে এক ধরনের মাইনর হেমোরেজ হয়। এ জাতীয় রক্তপাত জীবন সংশয় করে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্লাটিলেট দিলে রোগীর সমস্যা দূরও হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, প্লাটিলেট ৫০ হাজারের নিচে কমতে শুরু করলে শুধু একজন দাতা প্রস্তুত রাখলেই চলবে। ডেঙ্গু রোগীকে কখন প্লাটিলেট দেবেন, তার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা না গেলে এবং প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে না নামলে প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে অনেকেই দিনে তিনবার করে প্লাটিলেট পরীক্ষা করতে থাকেন। এটা অহেতুক উদ্বেগ তৈরি করে। রোগী ও স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে যান। প্লাটিলেট ৩০ হাজারের নিচে কমলেই অনেকে রোগীকে আইসিইউতে নিতে চান।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম না থাকলে এবং রক্তচাপ ও অন্য প্যারামিটার স্বাভাবিক থাকলে রোগীকে আইসিইউতে না নেওয়াই ভালো। আইসিইউ বরং বাড়তি চাপ। অহেতুক ইনফেকশনের উৎসও বটে। একাধিক ল্যাবে প্লাটিলেট পরীক্ষা না করাই ভালো। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। প্লাটিলেট কাউন্ট প্যাথলজিস্টভেদে ও ল্যাবরেটরিভেদে পাঁচ-দশ হাজার এদিক-সেদিক হতে পারে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গিয়ে যখন বাড়তে শুরু করে, তখন বাড়তেই থাকে। ডেঙ্গুতে খুব কম রোগীর ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসককে প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। নিজেদের আতঙ্কের ভার চিকিৎসকদের ওপর চাপাবেন না।
ডেঙ্গুর মূল জটিল অবস্থাটির নাম ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এটা প্লাটিলেটজনিত কোনো সমস্যা নয়। ডেঙ্গু ভাইরাস ও শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী শক্তির যুদ্ধের কারণে রক্তনালির ছিদ্রগুলো বড় হয়ে যায়। তখন রক্ত থেকে রক্তের জলীয় উপাদান বাইরে বেরিয়ে আসে। এ অবস্থায় রক্তচাপ কমে জমায়, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়, ফুসফুস ও পেটে পানি জমে। এটা খুবই খারাপ একটি পর্যায়। এ পরিস্থিতিতে কিছু কিছু রোগী মারাও যান। ডেঙ্গুতে যে বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়, তা শক সিনড্রোমের জটিলতায় ডিআইসি বলে এক ধরনের রক্তের অসুখে হয়। এখানেও প্লাটিলেট দিয়ে তেমন কাজ হয় না। রোগী শকে গেলে রক্তচাপ কমে যায়, অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, হিমাটোক্রিট বেড়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়। তাই ঘন ঘন প্লাটিলেট দেখার চেয়ে এগুলো পর্যবেক্ষণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্লাটিলেটের কম বা বাড়া দেখে রোগের তীব্রতা বোঝা যায় না। প্লাটিলেট ভালো থাকার পরও রোগী শকে চলে গেছে এমন ঘটনা অনেক রয়েছে।
শকের মূল চিকিৎসা স্যালাইন। অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসাব করে মাত্রা বুঝে স্যালাইন দেবেন। পরিস্থিতি বুঝে লাল রক্তও দিতে পারেন। রোগী বাসায় থাকলে খেয়াল করবেন বমি ও পাতলা পায়খানা করছে কি না। এগুলো ডেঙ্গু রোগীকে দ্রুত শকের দিকে ঠেলে দিতে পারে। অচেতন ভাব, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা থাকলে দ্রুত হাসপাতালে নেবেন। আতঙ্ক নয়, সতর্কতা জরুরি। এ ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, আগাম প্লাটিলেট দিয়ে প্লাটিলেটের কাউন্ট বাড়িয়ে রাখার চিন্তাটি বিজ্ঞানসম্মত নয়। বরং এতে জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ