শাশ্বতী মাথিন
জীবনটা সহজ ছিল না তাঁর। জীবনের প্রথম লড়াটাই ছিল নিজেকে নিজের গ্রহণ করার। এর পর সমাজ তাঁকে কতটা গ্রহণ করবে, সেটাও। সমাজে সম্মানের সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা আর নিজের অধিকারগুলো আদায় করার এই লড়াইটা শুরু হয়েছে বয়ঃসন্ধি থেকে, চলছে আজ অবধি।
যাঁর কথা বলছি, তিনি ট্রান্সজেন্ডার নারী মৃত্তিকা রেই। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (এনএইচআরডিএফ) অর্থায়নে ও ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এনএসডিএ) তত্ত্বাবধানে ও বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং সেক্টরের পথপ্রদর্শক উজ্জ্বলার যৌথ উদ্যোগে একটি কোর্স করে বিউটি আর্টিস্ট হয়েছেন তিনি। সঙ্গে করছেন আরো কিছু কোর্স। বিউটিফিকেশনের কাজ করে যাচ্ছেন ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে। নিজেকে তো স্বাবলম্বী করার পথে এগিয়ে যাচ্ছেনই, পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডার সমাজের মানুষকেও সম্মান নিয়ে বাঁচার যে মৌলিক অধিকার রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
মৃত্তিকা রায়ের জীবনসংগ্রাম এবং বিউটি আর্টিস্ট হয়ে ওঠার গল্পই শুনব তাঁর মুখে-
নিজের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলতে ইচ্ছা হতো
আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। আমার দেহের অঙ্গগুলো পুরুষের। কিন্তু আমার মন-মস্তিষ্ক একজন নারীর। আমার আগ্রহ মেয়েলি বিষয়ে। আমার খুব সাজতে ভালো লাগত, নারীর মতো পোশাকে আগ্রহ পেতাম। ভাবনাগুলোও আমার একজন নারীর মতো। এটা প্রকৃতগত বিষয়। অনেকের কাছে বিষয়টি শুনতে অবাক, আশ্চর্য লাগলেও, এটাই প্রকৃতগত, হরমোনগত।
ছোটবেলা থেকেই আমার থাইরয়েড হরমোনে কিছু সমস্যা ছিল। বয়ঃসন্ধির সময় দেহের যে পরিবর্তনগুলো আসে, সেগুলো আসতে কিছুটা দেরি হচ্ছিল আমার। তখন থেকেই বুঝতে পারছিলাম, আমি নারীদের কাজে বেশি আগ্রহ পাই। নিজের পুরুষাঙ্গটিকে একটি বোঝা মনে হতো। মনে হতো, এটা কেটে ফেলি। শরীর পুরুষের কিন্তু মনটি নারীর–– এটা যে কী এক ভয়ানক ও তীব্র যন্ত্রণার, সেটা বোঝানো কঠিন। কখনো কখনো মনে হতো আত্মহত্যা করি।
ছোটবেলায় প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার চলাফেরা নিয়ে এলাকায় সালিশ বসত। আমার মা ভাবতেন, আমি বখে গেছি। বাজে লোকের সঙ্গে মিশছি। একবার মা ছোট ভাইকে দিয়ে আমাকে মার পর্যন্ত খাওয়ান। এক পর্যায়ে আমার থাইরয়েডের চিকিৎসক বললেন, মানসিক চিকিৎসক দেখাতে। প্রথমে আমি ঢাকা মেডিকেলে যাই। তবে সংকোচের কারণে চিকিৎসকদের কিছু বলতে পারছিলাম না। দীর্ঘদিন আমাকে মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ খেতে হয়। অনেক জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত আসি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। সেখানে দেখানোর এক পর্যায়ে একজন নারী চিকিৎসক বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং বলেন, ‘আমি ট্রান্সজেন্ডার নারী।’ তাঁর মাধ্যমে আমি প্রথম জানলাম এ বিষয়ে। তিনি বললেন, ‘সারা বিশ্বে এই রকম অনেক নারী রয়েছে। এটা একদমই প্রকৃতগত বিষয়। মানুষের এখানে হাত নেই। আর এটা যে খুব অস্বাভাবিক, তাও নয়।’ তিনিই প্রথম বোঝালেন, ‘তোমার যেভাবে নিজেকে রাখতে ভালো লাগে, তুমি সেভাবেই থাকো।’
এর মধ্যে পরিবারের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে আমি বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাই। এইচএসসি পাসের পর অনার্সে ভর্তি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আমায় নিয়ে বাজে মন্তব্য করত। লেখাপড়াও ছেড়ে দিই। একা একটা মানুষ নিজের সঙ্গে তো লড়ছিলামই; এর সঙ্গে যুক্ত হলো অর্থনৈতিক সংগ্রাম।
যা কিছু শিল্প, সব ভালো লাগে
আমি ব্লগ লিখি ট্রান্সজেন্ডার সমাজের মানুষ নিয়ে; তাদের অধিকার, ভালো-মন্দের বিষয় নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই আমার ভেতর ভীষণ একটা শিল্পীসত্তা ছিল। গান পছন্দ করতাম। গান গাইতে ভালোবাসতাম। এখনো মাঝে মাঝে গাই। রং-তুলি, ছবি তোলা, নিজে সাজা, কাউকে সাজানো, অর্থাৎ যা কিছু আর্ট (শিল্প) তার সবই আমার ভালো লাগে। সেই শিল্পীসত্তাকেই এখন কাজে লাগাচ্ছি বিউটি আর্টিস্ট হয়ে। ২০২৩ সালেই এনএইচআরডিএফের অর্থায়নে ও ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এনএসডিএ) তত্ত্বাবধানে ও ‘উজ্জ্বলা’র যৌথ উদ্যোগে বিউটিফিকেশনের ওপর বিনামূল্যে একটি কোর্সে ভর্তি হই। কাজ শেখার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে উজ্জ্বলার সহপ্রতিষ্ঠাতা আফরোজা পারভীন ম্যাম আমাকে বাংলাদেশ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন ও উজ্জ্বলার যৌথ উদ্যোগে হওয়া আরেকটি কোর্সে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেন। দুটো কোর্সই সরকারি। আমার প্রশিক্ষণ এখনো চলছে। আমি মনের ক্ষুধা থেকে শিখছি, কারণ, এটা আমার মনের ক্ষুধাও মেটায়। আমার প্রশিক্ষণ এখনো চলছে। তবে এর পাশপাশি বিউটিফিকেশনের ওপর ফ্রি ল্যান্সিং শুরু করে দিয়েছি। ক্লাইন্টও পাচ্ছি।
আমি যা, উজ্জ্বলা সেটা হতে সাহায্য করেছে
যেহেতু আমি মনেপ্রাণে একজন নারী, তাই নারীর সাজ ও গ্রুমিংয়ের যেই বিষয়–– সবটাই আমি পেয়েছি উজ্জ্বলার মাধ্যমে। উজ্জ্বলা আমাকে আমি হতে সাহায্য করছে। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও উজ্জ্বলার করা এসব যৌথ উদ্যোগের কারণে আমি বা আমার মতো অনেকেই বিনামূল্যে এসব আন্তর্জাতিক মানের কোর্স করতে পারছে। এটা খুবই আশার বিষয়।
ভবিষ্যতে, আমি নিজেকে অনেক স্বাবলম্বী হিসেবে দেখতে চাই। ট্রান্সজেন্ডার নারী হওয়ার কারণে সমাজে যে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয় আমাদের, সেই জায়গাটি থেকে বেরিয়ে এসে বিউটি আর্টিস্ট হিসেবে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত হবো, এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।
বি : দ্র : বাংলাদেশের বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্যোক্তা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে উজ্জ্বলা লিমিটেড। উজ্জ্বলায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং সংগ্রাম করে সাফল্য অর্জন করেছেন, এমন কয়েকজন নারী ও পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাতকাহনের ধারাবাহিক পর্ব চলছে। এই পর্বটি ছিল ৭১তম। উজ্জ্বলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন :
https://www.facebook.com/UjjwalaBD
https://www.instagram.com/UjjwalaBD/
ফোন : ০১৩২৪৭৩৪১৫৭