সাতকাহন২৪.কম ডেস্ক
ছোটবেলা থেকেই সাজগোজ পছন্দ করতেন তাহমিনা সুলতানা তুলি। তবে জীবনে একটি দুর্ঘটনার পরে বিউটি আর্টিস্ট হওয়ার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে বেছে নেন। উজ্জ্বলা থেকে কোর্স করে নিজেই একটি বিউটি স্যালন দিয়েছেন নীলফামারি জেলার ডোমার থানাতে। বর্তমানে মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তিনি এখন সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী। স্যালনে কাজ করার জন্য রেখেছেন আরো দুটি মেয়ে। নিজের সংসার নিজেই চালাচ্ছেন। এই পর্যায়ে আসার পেছনে উজ্জ্বলার কীভাবে সহযোগিতা করেছে সেই গল্পই শুনবো আজ তার মুখে ।
শ্বশুড় বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে দেয়নি
এইচএসসি পরীক্ষার তিন মাস আগে আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগে শ্বশুড় বাড়ি থেকে বলেছিলো লেখাপড়া করাবে। তবে এইচএসসি পরীক্ষার পরে আর লেখাপড়া করাতে চায়নি। তারা বলে, ‘কেন লেখাপড়া করাবে? আমরা কী চাকরি করাবো?’ স্বামীর সঙ্গে কথা বলার পর সে বলে, ‘কোনো একটি বেছে নিতে হবে।’ এরপর সংসার টেকানোর কথা ভেবে পড়া বন্ধ করে দিই। তবে সংসারের শান্তি রক্ষার জন্য যেই বিসর্জন দিয়েছিলাম, সেটি আমার ভাগ্যে জোটেনি।
২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সংসার ভালোভাবেই চলছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। আমি এক মাস বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে গিয়ে স্বামীর আচরণে বেশ পরিবর্তন খেয়াল করি। এক পর্যায়ে ঘর গুছাতে গিয়ে দেখি ইয়াবা, ফ্যান্সিডিল, গাঁজা ভরে রয়েছে। এসব দেখে কান্নাকাটি শুরু করি। ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো, মাথার উপরে ছাদ ভেঙে পড়ছে। স্বামীর কাছে জানতে চাইলে সে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এক মাস পর আবার এমন প্যাকেট দেখলাম। এ সময় আমার ওপর ভীষণভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে দেয় সে। আমাদের সন্তান হচ্ছিলো না।
এরপর আমি একটি সন্তান দত্তক নিই। স্বামীও রাজি হলো। ভেবেছিলাম সন্তানের দিকে তাকিয়ে সে হয়তো কিছুটা হলেও ঠিক হবে। কিন্তু সব আশায় গুঁড়েবালি। সে পরিবর্তন হয়নি।
নিজে কিছু করার জেদ ছিলো
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি আমার আব্বা মারা যায়। সে সময় আমার স্বামী এসে জানাজা পড়লো। আমাদের বাসায় থাকলো। ভেবেছিলাম, এবার হয়তো সে ঠিক হবে। কিন্তু তা-ও হলো না। একইভাবে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। আব্বা মারা যাওয়ার ৪০ দিন পর সিদ্ধান্ত নিলাম যে তার সঙ্গে আর থাকবাে না। তার অমানবিক আচরণ আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলো।
তবে আমার একটা জেদ ছিলো, অন্যের বোঝা হয়ে রইবো না। নিজে কিছু একটা করবো। তখন আমাদের এখানের একটি স্থানীয় পার্লারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম উজ্জ্বলা মেকআপের ওপর প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের জন্য খুবই ভালো। নীলফামারিতে উজ্জ্বলার একটি ক্লাস হয়েছিলো। সেটা খুব ভালো লাগলো। আমার মনে হলো এখানেই আমার শিখতে হবে। তবে বাসা থেকে ঢাকা গিয়ে শেখার বিষয়টিতে কেউ মত দিচ্ছিলো না। সে সময় আমার ভাবি আর বোন সহযোগিতা করে এবং শেখার জন্য কিছু টাকা দেয়। এরপর উজ্জ্বলায় সম্পূর্ণ কোর্স করি।
কঠিন সময় উজ্জ্বলা হাত ধরেছে
শিখতে শিখতে বাসায় কিছু কাজ করা শুরু করলাম। ২০২০ এর জানুয়ারিতে নিজে স্যালন দিই। মাসিক আয় হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয়।
আমি খুব কঠিন একটা সময় পার করছিলাম। দিশেহারা লাগতো। কী করবো, কীভাবে করবো -ভেবে পেতাম না। উজ্জ্বলা সে সময় আমার হাতটি ধরেছে। আমাকে আশার আলো দেখিয়েছে। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে উজ্জ্বলা। আমি এখন স্বাবলম্বী হতে পেরেছি এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য। উজ্জ্বলা আমাদের কেবল বিউটিফিকেশনের খুঁটিনাঁটি শেখায়নি। কীভাবে সবকিছু ব্যবস্থাপনা করে একটি স্যালন পরিচালনা করা যায়, সেটিও শিখিয়েছে।
প্রতিটি কোর্সে উজ্জ্বলার সহ প্রতিষ্ঠাতা আফরোজা আপা ব্রিফিং দিতো। তখন আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিলো। উজ্জ্বলায় বিশেষজ্ঞরা শেখান। তারা প্রতিটি বিষয় খুব নিঁখুতভাবে শিখেয়েছেন। উজ্জ্বলার জন্যই আজ এ জায়গায় এসে দাঁড়াতে পেরেছি।
অন্যরা পারলে, আমিও পারবো
উজ্জ্বলায় ক্লাস করতে গিয়ে যখন সবার গল্প শুনতাম, দেখতাম প্রত্যেকের জীবনেই একটি স্ট্রাগল রয়েছে। এসব শুনলে চোখে পানি চলে আসতো। মনে হতো, মানুষ কতো কষ্ট করে এগিয়ে যায়। আমিও পারবো।
উজ্জ্বলাতে তখন মানসিক স্বাস্থ্য ক্লাসের ফ্যাকাল্টি ছিলেন আঞ্জুমান পারভীন অভি। তার কাছ থেকে শিখেছি প্রতিকূল পরিবেশেও কীভাবে মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায়। আমাদের ডায়েট ক্লাসও ছিলো। উজ্জ্বলা বলতো কেবল অন্যকে সাজালেই হবে না। নিজেকেও গুছিয়ে রাখতে হবে। এগুলো বড় শিক্ষা জীবনে।
ভবিষ্যতে আফরোজা পারভীন আপার মতো প্রশিক্ষক হতে চাই। স্বপ্ন দেখি, উজ্জ্বলা নীলফারিতে শাখা করবে এবং আমি সেখানে কাজ করছি।
বি : দ্র : বাংলাদেশের বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্যোক্তা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে উজ্জ্বলা লিমিটেড। উজ্জ্বলায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং সংগ্রাম করে সাফল্য অর্জন করেছেন, এমন কয়েকজন নারী ও পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাতকাহনের ধারাবাহিক পর্ব চলছে। এই পর্বটি ছিলো ২৩তম।