Wednesday, November 19, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যজহির রায়হানের টুনি

জহির রায়হানের টুনি

অধ্যাপক আমেনা আক্তার ডলি

অমর কথাশিল্পী জহির রায়হানের অন্যতম উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’র এক ব্যতিক্রমধর্মী নারী চরিত্র টুনি। বয়স তার তেরো-চৌদ্দর মাঝামাঝি। টুনি চরিত্রটি আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তবে ভালোবাসার চিরন্তন ধারায় উজ্জ্বল। সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ টুনি কিশোরীসুলভ দুরন্তপনায় দুঃখ, জ্বালা-যন্ত্রণায় অত্যন্ত মানবিক। ঔপন্যাসিক আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তার মানসকন্যা টুনির চরিত্র সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন। টুনিকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের মূল ঘটনার অগ্রগতি ও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সে জন্যই এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র টুনি।

টুনি নবীনগরের শিকদার বাড়ির বউ। গায়ের রং কালো, ছিপছিপে দেহ, আয়ত চোখ। সমবয়সী কারও সঙ্গে দেখা হলে সবকিছু ভুলে মনের সুখে গল্প জুড়ে দেয় আর হাসে। হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় টুনি। তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, মনমানসিকতা বেড়ে উঠেছে আবহমান গ্রামবাংলায়। টুনি কিশোরীসুলভ চপলতার প্রতীক। পল্লিজীবন ও টুনির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। স্বচ্ছ প্রকৃতির সঙ্গে টুনির প্রাণ যুক্ত হয়ে তার চরিত্র হয়েছে সরল নির্মল।

খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল পরীর দিঘিরপাড়ের বুড়ো মকবুল শিকদারের সঙ্গে। মা-বাবার বড় আদরের মেয়ে টুনি। সংসার জীবনে অনেকটা অনভিজ্ঞ, উদাসীন। স্বামীর সঙ্গে বয়সের ব্যবধানের কারণে টুনির ছেলেমানুষি কিশোরীসুলভ মনোভাবটা মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই সমবয়সী পেলে সে মনের সুখে গল্প করে আনন্দ পায়। হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সংসারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নেই। স্বামীর প্রতি ভালোবাসাটাও প্রগাঢ় নয়। জীবনে তার স্বাদ, আহ্লাদ ও চাপল্যের পরিচয় প্রকট।

ঘরের দাওয়ায় বসে পুঁথির কথাগুলো গুনগুন করে টুনি। টুনি ছিল সংগীতপ্রিয়। সংস্কৃতমনা টুনির প্রতিভা বিকশিত হয়ে উঠতে পারেনি। এখানেও টুনি নিজেকে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। টুনির চোখ জোড়াও পানিতে টলটল করে ওঠে। তবে মুষলধারার বৃষ্টির মতো অঝোরধারায় ঝরে পড়ে না। এখানেও টুনি নিজের মনের কষ্ট না পাওয়ার বেদনা, যন্ত্রণা নিজের মাঝে একাত্ম করে দেয়।

স্বামীর বাড়িতে থেকেও টুনি তারুণ্যের প্রতীক খেলার সাথি মন্তুকে নিয়ে ভোররাতে জলাভূমিতে শাপলা তোলে, গভীর রাতে অন্যের পুকুরে মাছ চুরি করে আনন্দ পায়। বাপের বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নীরব নিঝুম রজনীতে মন্তুকে নিয়ে সে নিজেই গাছে চড়ে খেজুরের রস নামিয়ে কলস ভরে। আবার সেই ভরা রসের কলস মাটিতে আছড়ে ভেঙে ফেলে। মন্তুর প্রতি টুনির অবচেতন মনের ভালোবাসা, ভালোলাগা না পাওয়ার যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত, জর্জরিত রক্তাক্ত হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। জীবনে না পেল স্বামীর একনিষ্ঠ ভালোবাসা, না দিতে পারল মন্তুকে তার অন্তরের অন্তস্তল থেকে নির্ভেজাল ভালোবাসা। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, জীবনের নিষ্ঠুর কারাগারে টুনি বন্দি। হীরণের বিয়েতে আম্বিয়া মন্তুর ঘরে প্রবেশ করেছিল; সে সময় সকলের রসিকতাকে থামিয়ে দিয়েছিল টুনি। মেনে নিতে পারেনি মন্তুর সঙ্গে আম্বিয়াকে জড়িয়ে কোনো কথা।

তার প্রেম প্রকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে মন্তুর হাতে মেহেদি মাখানোর মাধ্যমে। তার ভালোবাসার মেহেদিতে রাঙিয়ে দিয়েছে মন্তুর হাত দুখানি। টুনি যে একজন নারী এবং তার জীবনেও চাওয়া-পাওয়া আছে, তা সে মন্তুর সাহচর্যে এসে বুঝতে পেরেছিল। বুড়ো মকবুলের তৃতীয় স্ত্রী হয়ে যে নারীত্ব সুপ্ত হয়ে পড়ে, মন্তুর সংস্পর্শে তা আবার জেগে উঠল।

বুড়ো মকবুল তাকে যা-দিয়েছে, সংসারজীবনে তাতে তার মনমানসিকতা আত্মতৃপ্তিতে পরিপূর্ণতা পায়নি। সে কারণেই টুনির জীবন শূন্যতা আর রিক্ততায় ভরে ওঠে। মকবুলের প্রতিও টুনি ছিল বিরক্ত। তাই মন্তুর এক প্রশ্নের জবাবে টুনি বলল, ‘মরলেই তো বাঁচি।’

ভালোবাসার পাশাপাশি অবস্থান করে ঈর্ষা। আম্বিয়ার প্রতি তার কোনো ক্ষোভ ছিল না। তবে যখন আম্বিয়ার সঙ্গে মন্তুর বিয়ের কথার আলোচনা শোনে, তার সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়। কিছুতে মেনে নিতে পারেনি মন্তুর সঙ্গে আম্বিয়ার বিয়ে। তাই বিয়ে ঠেকানোর জন্য টুনি বুড়ো মকবুলকে প্ররোচনা দিয়ে প্রলুব্ধ করে আম্বিয়াকে বিয়ে করার। মন্তুর প্রতি তার মনের দুর্বলতা এত প্রবল ও তীব্র ছিল যে আম্বিয়াকে সতিন করে নিতেও আপত্তি ছিল না। মন্তুর প্রতি আম্বিয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক, তা টুনি সহ্য করতে পারেনি। এটা একনিষ্ঠ প্রেমের ধর্ম। এখানটায় টুনি চরিত্র উজ্জ্বল, স্পষ্ট।

অসুস্থতার পর স্বামী মকবুলের সেবা-শুশ্রূষা করেছে। সারাক্ষণ টুনি ওর আশপাশে থাকে। একটু অবকাশ পেলে রসুই ঘরে গিয়ে রান্নাবান্নার পাটটা সেরে আসে। সে মরিচগাছ আর লাউ-কুমড়োর গাছগুলোর তদারক করে আসে। অবশেষে টুনির সেবা-যত্নকে অস্বীকার করে মৃত্যু চিরকালের, চিরদিনের জন্য তার স্বামীকে নিয়ে গেল।

টুনি একা হয়ে গেল। সারা দুপুর টুনি কাঁদল। সারা বিকেল। সারা সন্ধ্যা। মকবুলের মৃত্যুর পর টুনির কল্পনা আর বাস্তবতার সত্যতা উপলব্ধি করতে পেরেছে মর্মে মর্মে। কবি ভাষায়, ‘মানুষ যা চায় তা পায় না, আর যা পায় তা ভুল করেই পায়।’ একাকিত্বের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যায়, চোয়ালের হাড় দুটো বেরিয়ে আসে। চোখের নিচে কালি পড়ে। মুখখানা বিষণ্ণ, মাথায় ছোট একটা ঘোমটা। যে টুনি হেসেখেলে বেড়াতে পছন্দ করত, সে আজ স্থির। একদিন মন্তুকে আস্তে করে বলল, ‘আমারে একদিন সময় কইরা আমাগো বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া আইবা।’ টুনি শিকদারবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি ফিরে যেতে চায়। যেখানটায় ছোট ঘর, মালপত্র ভরা। কয়েকটা বড় বড় মাটির ঘটি এক কোণে রাখা, তার পাশে তিন-চারটা বেতের ঝুড়ি। উত্তর কোণে দড়ির সঙ্গে ঝুলছে টুনির দুখানি শাড়ি। একটা ময়লা কাঁথা। তা ছাড়া ঘরের ঠিক মাঝখানে ছিল কাঠের সঙ্গে কতগুলো শিকে। শিকের মধ্যে কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল রাখা।

টুনি তার জীবনে দারিদ্র্যকেও দেখেছে। তাই উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত জীবন্ত টুনির বিয়ে হয়েছে দুই সতিনের ঘরে। আজ টুনি রেখে আসা গরিব বাবার গৃহে বিধবা হয়ে এ অল্প বয়সে ফিরে যায়।

সবার গলা জড়িয়ে টুনি কাঁদল। বিদায় নিল। পরীর দিঘিরপাড়ের ওপর দিয়ে আসার সময় দূর থেকে বুড়ো মকবুলের কবরটা চোখে পড়ল। শুকনো মাটির ঢেলাগুলো ঢিপির মতো উঁচু হয়ে আছে। টুনির চলে যাওয়া খুব কষ্টের। মন্তু নৌকার বাইরে এসে বসতে বলল। তবে টুনি সহসা এসে বসল না। আজ নদীর জলে হাতের পাতা ডুবিয়ে দিয়ে খেলা করল না। উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে তাকাল না কোনো দিকে। টুনির জীবনের এ পরিবর্তন কঠিন রূঢ় বাস্তবতার। শুধু বলল, ‘আম্বিয়াকে বিয়ে কইরলে এই নাওডা তোমার অইয়া যাইব না।’ শান্তির হাটের কাছে এসে মন্তু টুনিকে বলল, ‘মনোয়ার হাজিরে কইলে ও মোল্লা ডাইকা সব ঠিক কইরা দিব।’ প্রতি উত্তরে টুনি বলল, ‘না, তা আর অয় না মিয়া, তা অয় না।’ যে টুনি আম্বিয়ার সঙ্গে মন্তুর বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছে, সে আজ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে বাস্তবতাকে। আজ এতটা কাছে পেয়েও মন্তুর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছে টুনি। টুনির জীবনের ট্র্যাজেডি উপন্যাসে টুনি চরিত্রকে শুকতারার মতো উজ্জ্বল করে রেখেছে।

গ্রামবাংলার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের চিত্র চিত্রিত করতে গিয়ে লেখক ব্যতিক্রমধর্মী টুনি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। আমাদের গ্রামবাংলার অদৃষ্টবাদী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে কেউই আপন ব্যক্তিত্ব নিয়ে আপন ইচ্ছা, আপন আকাঙ্ক্ষা প্রচার করে টিকে থাকতে পারেনি। টুনি গতানুগতিকতার চক্র ছিন্ন করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। টুনি জহির রায়হানের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সে যেন এ যন্ত্রণাময় সংসার সমুদ্রের অনির্বাণ দীপশিখা। যতবার সে বেদনাময় জীবনের খেলাঘরে উৎসবের বাসর সাজাতে চেয়েছে, ততবারই তার সে সাধ নিষ্ঠুর নিয়তির নির্মম পরিহাসে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যদিও লেখক গতানুগতিক প্রথায় কাহিনিপ্রধান উপন্যাস সৃষ্টি করেননি, তবুও তিনি রূঢ় বাস্তব জীবন পরিবেশ বিচরণশীল নর-নারীর সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনায় মেশানো জীবনকে উপেক্ষা করতে পারেনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

সাতকাহন
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.