Thursday, December 12, 2024
spot_img
Homeস্বাস্থ্যকাহননারী স্বাস্থ্যজরায়ুমুখের ক্যানসার : কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

জরায়ুমুখের ক্যানসার : কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

জননীর কাছে সবার রয়েছে জন্মঋণ, জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতায় অংশ নিন। এই শ্লোগান নিয়ে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসকে জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। সমাজের যে অংশের নারী এতে প্রধানত আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে রোগটি নিয়ে সচেতনতার অভাব প্রচণ্ড। বিষয়টি নিয়ে লজ্জা- সংকোচ তাদের বিরত রাখে পরীক্ষা- নিরীক্ষা ও চিকিৎসা মুখী হতে। নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থাও বড় বাধা।

স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতায় ইতোমধ্যে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি এগিয়ে নেওয়া দরকার জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসকে জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়।

জরায়ুমুখের ক্যানসার কী?

মায়ের পেটে জরায়ু বা ইউটেরাস নামক অঙ্গটির ভেতরে আমরা প্রত্যেক মানুষ জন্ম নিই। এই জরায়ুর নিচের দিকে সরু অংশটিকে বলা হয় জরায়ুমুখ, ইংরেজিতে সারভিক্স। এই সারভিক্সের ক্যানসারকে বলা হয় সারভাইক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যনসার। পুরো জরায়ু থেকে জরায়ুমুখের ক্যানসার একটু ভিন্ন প্রকৃতির।

জরায়ুমুখের ক্যানসারে একজন নারী আক্রান্ত হয় কেন ?

জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কতগুলো আর্থসামাজিক এবং কিছু ব্যক্তিগত কারণ রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের বেলায় যেখানে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বেশিরভাগই একটু নিম্ন পর্যায়ের থাকে, আমরা প্রধানত দায়ী করি বাল্যবিবাহকে। খুব অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে এবং অল্প বয়সে সন্তান হলে, বেশি সন্তান হলে, ঘন ঘন সন্তান হলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এগুলো অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব। বিশেষ করে মাসিকের সময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় না থাকলে এ সমস্যা হতে পারে। অপুষ্টি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে অন্য কারণগুলোকে উৎসাহিত করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা। আমাদের দেশে সমস্যাটি বাড়ছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এই হারটা বেশি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) ভাইরাসকে বলা যায় দুষ্টু ভাইরাস। এই ভাইরাসের সংক্রমণ বারবার হলে জরায়ুমুখের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

জরায়ুমুখের এই ভাইরাসের সংক্রমণ কি করে হয় ?

শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে মূলত এই ভাইরাস ছড়ায়। একাধিক সঙ্গীর সাথে মেলামেশা বয়ে আনতে পারে নারীর জন্য এই ভয়াবহ বিপদ। বিপথগামী স্বামী কিংবা পুরুষ সঙ্গীর কারণে একজন নারী আক্রান্ত হতে পারেন। এ ছাড়া এইচপিভি ভাইরাসের কারণে শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও সংক্রমণ হয়।

জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হলে কী সমস্যা হয়?

মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব যাওয়া। মাসিকের রাস্তায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি কয়েক রকম হতে পারে। যেমন: প্রতিমাসে নারীদের মাসিকের সময়কাল হঠাৎ করে বেড়ে যায়, যে পরিমাণ রক্ত সাধারণত যায়, এর থেকে বেশি পরিমাণ রক্ত যাওয়া শুরু হয়, মাসের মাঝখানে আবার এ রকম রক্তক্ষরণ হয়। মেনোপজ অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর, হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর রক্তক্ষরণ হয় বা ব্যথা হয়। এগুলো হলো প্রধান লক্ষণ। তবে রোগটি যখন একটু বেড়ে যায়, যখন আশপাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হয়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে আরো কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়।

প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা যায় কীভাবে?

উপরে যে লক্ষণগুলোর কথা বলা হলো তা প্রকাশ পাওয়া মাত্রই একজন রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় হলে, চিকিৎসায় অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
জরায়ুমুখের ক্যানসারের বেলায় একটি বিশেষ আশাবাদের জায়গা রয়েছে। আমরা জানি কোষের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিবর্তন থেকে একপর্যায়ে ক্যানসার হয়। জরায়ুমুখের ক্যানসারের বেলায় প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে পূর্ণাঙ্গ বা আগ্রাসী ক্যানসারে রূপ নিতে। লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই এই ক্যানসার আমরা নির্ণয় করতে পারি। এখানে দুটো প্রধান পরীক্ষা রয়েছে। প্যাপটেস্ট, যাকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়। আরেকটি হলো ভায়া টেস্ট, VIA। এই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে সহজে ক্যানসার স্ক্রিনিং করা যায়।

প্যাপটেস্ট কী?

একটি কাঠের কাঠির মতো, আইসক্রিমের সঙ্গে যেমন চামচ দেওয়া থাকে, অনেকটা সেরকম দেখতে ‘স্প্যাচুলা’র সাহায্যে জরায়ুমুখের ভিতর দিক থেকে কষ এনে তা দিয়ে স্লাইড বানিয়ে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয় কোন অস্বাভাবিক বা ক্যানসার কোষ রয়েছে কি না। কোন কাঁটা ছেঁড়ার দরকার পড়ে না।

ভায়া টেস্ট কী?

এই পরীক্ষাটি আরো সহজ। প্রায় নিখরচায় এটি করা সম্ভব। প্যাপটেস্টের মতোই রোগীকে প্রস্তুত করে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ এসিটিক এসিডে ভিজানো একটি সোয়াবস্টিক (মাথায় তুলা লাগানো কাঠি) জরায়ুমুখের ভিতর দিয়ে স্পর্শ করে এক মিনিট পর পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোন সাদা দাগ পড়লে ভায়া পজেটিভ, না পড়লে নেগেটিভ। এখানেও কাটা ছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে স্লাইড দেখার প্রয়োজন না হওয়ায় সামান্য খরচে অনেকের পক্ষেই এই পরীক্ষা করা সম্ভব। তবে ভায়া পজেটিভ হলেই জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত, না হলে একেবারেই বিপদমুক্ত, এমনটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। পরে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট এর মত আধুনিক আরো কয়েকটি পদ্ধতি এই ক্যানসার নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।

চিকিৎসা

চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবাই মিলে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। সাধারণত চারটি পর্যায়ে আমরা রোগের অবস্থাকে ভাগ করি। ১,২,৩ ও ৪। এর মধ্যে আবার এ, বি- এভাবে ভাগ করা হয়। যখন স্টেজ বা পর্যায় ২- এ পর্যন্ত থাকে, তখন প্রধান চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার করে ফেলা ফেলে দেওয়া। পরে যদি অন্যান্য চিকিৎসা লাগে সেগুলো প্রয়োগ করা হয়। এই চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। আর দেরি হয়ে গেলে বা ওই পর্যায়টি পার হয়ে গেলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার করা যায় না। রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পর, অনেকক্ষেত্রে আবার অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া যায়। যত আগে ধরা পড়বে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এই রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এসব বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী, জননীর জন্য পদযাত্রা
নির্বাহী পরিচালক, সিসিইপিআর,বি
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরাম
সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিউট ও হাসপাতাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments