মোশাররফ হোসেন রিপন
রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে নিধি। বলে দিয়েছে আমার সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই।
লকডাউনের সময় আহ্লাদি গলায় বলেছিল, ‘এসো একবার। মাঝখানে মাত্র দুটো গলি। মানুষ প্রেমের জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেয়। আর তুমি কি না দুটো গলি পার হয়ে একবার দেখা দিতে পারো না?’
তার এই ডাক প্রণয়ের ঐশ্বর্যে ভরা। আবেগ আর ভালোবাসা দুর্দান্ত প্রকাশ।
তবু আমার যাওয়া হয়নি। আমার অক্ষমতা তাকে বুঝতে দিইনি। তার অনুযোগ না বোঝার ভান করেছি।
সে চেয়েছিল আমি তার জানালা বরাবর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়াই। সে দোতলা থেকে এক পলক দেখবে। নেতাদের মতো করে হাত নাড়বে। দৃষ্টিসুখে লুতুপুতু হবে। প্রণয়ের আকাশে তখন প্রজাপতিগুলো নাল, নীল, বেগুনি পাখা মেলে উড়বে।
আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকব। বলে দিয়েছে, ‘আমি হাত নাড়তে পারব না। আশপাশের কেউ দেখে ফেলার ভয় আছে। ভয় তার জন্য না; আমার জন্য। দেখে ফেললে এলাকার ছেলেপুলেরা উত্তম মধ্যম দিয়ে হাত পা ভেংগে দিতে পারে।’
আমি সব শুনে বললাম, ‘সম্ভব না।’ সে ক্ষেপে গেল। এতক্ষণ ক্ষুদেবার্তা আদান প্রদান চলছিল। এবার সরাসরি কল দিল। বুঝতে পারছি রাগে ফুঁসছে। আমি ফোন ধরিনি। এই ক’দিন ভিডিও কলেও যাইনি। ফোনে না পেয়ে আবার ক্ষুদেবার্তায় ফিরে এলো। নানান ধরনের ক্রোধান্বিত প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে উঠল ইনবক্স। এত রকমের অদ্ভুত প্রতীকী চেহারা জীবনেও দেখিনি।
আবারো দমকা হাওয়ার আঁচড় পড়লো-
– ‘কেন সম্ভব না?’
বুঝতে পারছিলাম অবস্থা বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ভাবছি, কীভাবে ব্যাপারটা সহজ করা যায়।
– ‘সম্ভব না। কারণ তোমাদের এলাকায় কাকের মেলা বসেছে। আন্তঃজেলা কাক মেলা। আকাশ গাছ পালা সব এখন তাদের দখলে। ওদের মেলা চলার সময় উপরের দিকে তাকাতে নেই।’
– ‘মানে!’
– ‘তাকালে মান-ইজ্জত যায়।’
– ‘কাক-টাক কী বলছ এসব?’
– ‘বললে না গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে! এভাবে তাকালে জামা কাপড় নষ্ট হবে; তাও সমস্যা নেই। কিন্তু গলা দিয়ে নেমে পেটে চলে গেলে সমস্যা। আমার আবার এলার্জি আছে জানো তো। গাড়িতেও বমি আসে। কাকের ইয়ে খেয়ে বমি করে যদি নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যায়! বাঁচবো তো?’
– ‘কাকের মেলা এখানে না আপনার মাথায়। আর আপনাকে হা করে তাকাতে বলেছে কে?’
রেগে গেলে সে তুমি থেকে আপনিতে চলে যায়।
– ‘তুমি না বললে একটু আগে?’
– ‘অহ আচ্ছা তাই না! আচ্ছা। আপনি হা করে থাকলেও সমস্যা নেই। মুখে যেহেতু মাস্ক থাকবে, তাই আপনার গলা দিয়ে নামার ভয় নেই। এবার সোজা চলে আসেন। মাফ নেই।’
– ‘মাস্ক পরবো নাকি?’
– ‘জি মাস্ক পরবেন।’
– ‘তাহলে তো আর চেহারা দেখা যাবে না। একটা মাস্ক দেখাতে এতদূর যাবো? তুমি তো এটা ঘরে বসেই দেখতে পারো।’
– ‘আমার মেজাজ কিন্তু চড়ে যাচ্ছে!’
– ‘চড়া মেজাজ নিয়ে আয়নার দিকে তাকিও না নিধি। রাগলে তোমাকে অদ্ভুত লাগে। ভয় পেয়ে বেহুঁশ হয়ে যেতেও পারো।’
– ‘একদম চুপ। কোনো কথা না।’
– ‘আচ্ছা চুপ করলাম।’
– ‘তো ভিডিও কলে আসেন না কেন? আপনার মতলবটা কি বলেন-তো শুনি?’
– ‘হঠাৎ সন্ন্যাসী দেখলে তুমি ভয় পেয়ে যাবে তাই। জান তো কত দিন ধরে সেলুনে যেতে পারি না। দাড়ি-গোঁফ লম্বা হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে; মাজারের ফকিরের মতন।’
– ‘চেহারা দেখাবেন না ভালো কথা। কথা বলতে সমস্যা কী? ফোন ধরলে কী হয়? উফফ! ইচ্ছে করছে——।’
– ‘এখন আমার কী মনে হয় জানো নিধি? মনে হচ্ছে আমি সত্যিকারের সন্ন্যাসী হয়ে গেছি। ধ্যানে বসে দেখলাম; অদ্ভুত একটা জগতে আমি বিচরণ করছি। এ সময় কিন্তু কথা বলা যায় না। নিয়ম নেই।’
– ‘এসব কী হচ্ছে? এতো দেখি পুরাই পাগল!’
– ‘সন্ন্যাসীদের পাগল বলতে নেই; পাপ হয়। তোমার কাছে কী একটা হলুদ শাড়ি হবে? পেঁচিয়ে দেখতাম। অবশ্য নতুন কাপড় লাগবে। নারীর পরিধেয় কাপড় সন্ন্যাসীর শরীরে লাগাতে নেই। ধ্যানভঙ্গ হয়।’
– ‘হুহ! সত্যি তাহলে সন্ন্যাসগ্রহণ করেছেন? বেশ। সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।’
তারপর সাথে সাথেই ব্লক করে দিলো। এভাবে মাস পার হয়ে গেল। আর কোনো যোগাযোগ হলো না। এদিকে আমার সন্ন্যাসজীবনও শেষ হয়ে এলো।
লকডাউন খুলে দিয়েছে। অফিস শুরু হয়েছে। গনপরিবহন চালু হয়েছে। কিন্তু চারিদিকে প্রচুর লোক করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। কারো কারো অবস্থা সংকটাপন্ন।
আমি এগিয়ে গেলাম অপরিচিত একজনকে সাহায্য করতে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়েছি। মাথার উপর গমগমে রোদ। ভালো করে চোখ মেলা যাচ্ছে না।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির কালো কাঁচ ধীরে ধীরে নেমে গেল। ভেতর থেকে অস্ফুট গলায় ডাক দিল কে যেন। পরিচিত লাগছে, আবার লাগছে না। তাকিয়ে দেখি নিধি। সেকেন্ডের মধ্যেই নেমে এলো সে।
একি অবস্থা হলো মেয়েটির! এলোমেলো চুল। মাস্কের জন্য দেখা না গেলেও বুঝা যাচ্ছে বিদ্ধস্ত চেহারা। চোখের কোণায় শিশির বিন্দু জমেছে। অস্থির চোখ দুটোতে আতংকের স্পষ্ট ছাপ।
– ‘নিধি তুমি এখানে?’
সে আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হাউমাউ করে বলল, ‘আমার আব্বুর করোনা পজিটিভ। অবস্থা খুবই খারাপ। তবে প্লাজমা জোগাড় হয়েছে। এখন প্লাজমা নিচ্ছে।’
তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি শান্তনা দিতে গিয়েও কেঁপে উঠলাম। ঠিক কি বলতে হবে জানি না। তার চোখের পানি মুছে দিতে ইচ্ছে করল ভীষণ। তাদের গাড়িতে থাকা কিছু কৌতুহলী চোখের দিকে নজর পড়াতে নিবৃত হলাম।
যার কথায় আমি হাসপাতালে এসেছি তিনি এলেন।
হাসপাতালের দিকে ছুটার আগে তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে নিধিকে বলল, ‘উনিই আংকেলকে প্লাজমা দিয়েছেন।’
তারপর হাতে থাকা কিছু পথ্য নিয়ে হাঁটা ধরেছেন হাসপাতালের দিকে। ধরে নিলাম এই ভদ্রলোক নিধির কাজিন। আগে জানা ছিল না।
নিধির চোখ ছানাবড়া। অবাক হতে হতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল যেন।
– ‘তুমি — মানে — তুমি—-?’
– ‘আমি অপলক তাকিয়ে থাকি।’
– ‘তুমি প্লাজমা দিয়েছ মানে?’
– ‘হুম। ওই যে আমার সন্ন্যাসজীবন। তাই প্লাজমা দিতে পেরেছি।’
– ‘তোমার করোনা হয়েছিল? হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বলল।’
এবার শব্দ করে কাঁদছে। খুব চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারছে না। বুঝে নিল এই দূরত্বের পেছনের কারণ ছিল করোনা।
আবেগের অতিশয্যে কি না, সে দ্রুত দু’কদম এগিয়ে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডানে বামে তাকালো। তবে থেমে যেতে হলো কোনো কারণে। হয়ত কোনো ইচ্ছে চারপাশের কিছু দৃষ্টির কাছে হার মেনেছে।
সে অস্ফুট গলায় বলল, ‘আমাকে বললে কী হতো?’
বললাম, ‘আমার জন্যও কি চোখের জল ফেলতে? বা ফেলছো এখন?’
সে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বললো না। কিছু কথা না বলাতেই সুন্দর।
নারীর চোখে সমুদ্র বাস করে। কারণে- অকারণে তাতে জোয়ার বয়ে যায়। আবেগ, দুঃখ, কষ্টের অনুভূতিতে জোয়ার আসে। জলের ধারা বহন করে কেবল চোখ দুটোই। চোখের জলে কোনো রং থাকে না। একই জল ভিন্ন ভিন্ন কষ্টে। ভিন্ন আবেগে, ভিন্ন অনুভূতিতে ঝরে। যার সমুদ্র শুধু সে-ই জানে।
নিধিইও জানে নিশ্চয়ই। কিছু অনুভুতি ছুঁয়ে গেল আমাকেও।
আমি কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ‘এখন আর কাকের মেলা নেই। সন্ন্যাসজীবনও নেই।’