Thursday, February 13, 2025
spot_img
Homeজীবনের খুঁটিনাটিচঞ্চল মাহমুদ : একজন আলোকচিত্রীর বর্ণময় জীবন

চঞ্চল মাহমুদ : একজন আলোকচিত্রীর বর্ণময় জীবন

শাশ্বতী মাথিন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরে শোকে এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি, সিদ্ধান্ত নেন আজন্ম কালো রঙের পোশাক পরার। এর পর থেকে নিজের কর্মজগতে, মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়, যেখানেই যাক না কেন– কেউ কখনো তাকে কালো পোশাক ছাড়া দেখেনি।

যার কথা বলছি, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য প্রথিতযশা ও পথিকৃৎ আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক চঞ্চল মাহমুদ। তাঁর হাতে ক্যামেরা যেন জাদুর ছড়ি। প্রাণহীন কালো ক্যামেরা তাঁর ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। কেবল আলোকচিত্রী নয়, বাংলাদেশের আলোকচিত্র শিল্পীদের অন্যতম শিক্ষকও তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘চঞ্চল মাহমুদ ফটোগ্রাফি স্কুল’ থেকে প্রায় ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ফটোগ্রাফি শিখে বের হয়েছে।

গত ১০ জুলাই বিকেল ৪টায় এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে যাই তাঁর গ্রিন রোডের বাসায়। এক দারুণ আলাপচারিতায় জমে ওঠে আড্ডা। কথোপকথনে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী দেশের আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন, বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তীব্র কষ্ট আর চোখের কোণে বোবাকান্না নিয়ে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছাকাছি পেয়েছি। কখনো ভাবতে পারিনি, তাঁকে এভাবে হত্যা করা হবে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। তাঁর দেওয়া পতাকা, অটোগ্রাফ এখনো রেখে দিয়েছি কাছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে একটি তীব্র আবেগের নাম। তাঁর চলে যাওয়ার পর দেশের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার এক বিরাট পরিবর্তন হলো। এই ক্ষতির জের এখনো এই দেশ টানছে।’

স্ত্রী রায়না মাহমুদের সঙ্গে চঞ্চল মাহমুদ।
স্ত্রী রায়না মাহমুদের সঙ্গে চঞ্চল মাহমুদ।

কয়েকবার হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়েছেন চঞ্চল মাহমুদ। রয়েছে ডায়াবেটিস। লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরে এসেছেন বছরখানেক আগে। স্ত্রী রায়না মাহমুদও লড়ছেন ক্যানসারের সঙ্গে। শারীরিক অসুস্থতা চঞ্চল মাহমুদকে কিছুটা ভোগালেও মানসিকভাবে এখনো রয়েছেন সেই তারুণ্যদীপ্ত, দৃঢ়চেতা মানুষটি। কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল, যেন এক আলোকদ্যুতি ছিটকে বের হচ্ছে তাঁর চেহারার ভেতর দিয়ে। বললেন, ‘লাইফ সাপোর্টে থাকার সময় সবাই ভেবেছিল, এই বুঝি চলে যাব। কোথায় কবর দেওয়া হবে, এটাও ঠিকঠাক। এরই মাঝে আল্লাহতায়ালা কীভাবে যেন ফিরিয়ে নিয়ে এলো। স্বামী-স্ত্রী দুজন অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে যেতে হয়েছে সেই সময়। এখনো যেতে হচ্ছে।’

চঞ্চল মাহমুদ
চঞ্চল মাহমুদ

আড্ডার এক ফাঁকে ট্রে-তে করে চা-বিস্কুট-কেক নিয়ে হাজির হলেন রায়না মাহমুদ (চঞ্চল মাহমুদের স্ত্রী)। ভীষণ অতিথিপরায়ণ এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলে মনেই হচ্ছিল না, তিনি আমায় প্রথম দেখেছেন। আবার শুরু হলো আলাপচারিতা। কথা বলছি আর ঘুরে ঘুরে দেখছি তাঁর বাসা।
সদর দরজার সামনে, শুরুতেই স্বামী-স্ত্রীর বিশাল এক ছবি টাঙানো। মজা করে চঞ্চল মাহমুদ বললেন, ”অমিতাভ বচ্চন ও জয়া বচ্চনের সিনেমা ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ দেখেছ? এই আদলে আমাদের এই ছবি।”

 স্ত্রী রায়না মাহমুদের সঙ্গে চঞ্চল মাহমুদ।

স্ত্রী রায়না মাহমুদের সঙ্গে চঞ্চল মাহমুদ।

চঞ্চল মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স, মাস্টার্স করেছেন। এরপর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন। ডিপ্লোমা করেন অস্ট্রেলিয়া থেকে এবং ফেলোশিপ করেন জাপান থেকে। অসংখ্য জাতীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনে কাজ করেন তিনি। তৈরি করেন নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস। ৫৫ বছরের ক্যারিয়ারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে তাঁকে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অনারারি ফেলোশিপ প্রদান করে।

আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুরুল আলম বেগ (এম এ বেগ) ছিলেন তাঁর ফটোগ্রাফির গুরু। গুরুর কথা বলতে গিয়ে জানালেন, বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির জগৎকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এই মানুষটি।

তরুণ চঞ্চল মাহমুদ।
তরুণ চঞ্চল মাহমুদ।

বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির অতীত ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথোপকথনের সময় চঞ্চল মাহমুদ বললেন, ” এ দেশে এই সেক্টরটি সবচেয়ে আলোচিত, তবে অবহেলিত। আমাদের ছবি ছাপা হয়, কিন্তু নাম প্রকাশ করা হয় না। নিচে লিখে দেওয়া হয় ‘সংগৃহীত’। একটু ঘাঁটলেই তো যিনি ছবিটি তুলেছেন, তাঁর নাম বেরিয়ে আসে। এখনকার জেনারেশনের অনেকে ড. নওয়াজেশ আহমেদ, নইবুদ্দিন আহমেদ, গোলাম কাসেমের নামই তো জানে না! আসলে কী জানো, একটি ছবি হাজারখানেক কথার চেয়ে অনেক শক্তিশালী! তবে আমরা এখনো এর পুরোপুরি কদর করা শিখিনি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা মেধাবী। তারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলে এই সেক্টরে আরো ভালো কাজ করতে পারবে এবং দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।’

ছবি তোলার পাশাপাশি পেইন্টিং, সংগীত, ভ্রমণ, আড্ডা, লং ড্রাইভ তাঁর ভীষণ পছন্দের। বলছিলেন, ‘ফটোগ্রাফির পাশাপাশি একটা সময় এগুলো করতে খুব ভালোবাসতাম। এখন অবশ্য অসুস্থতার কারণে কিছু বিষয় হয়ে ওঠে না। তবে প্রচুর গান শুনি। আর প্রতিদিন সিনেমা দেখি। আসলে শিল্পীর একটি নিজস্ব চোখ থাকতে হয়। আর এটিই তাঁকে সবার চেয়ে আলাদা করে তোলে। আর এই দেখার চোখ তৈরি করতে হয় মানুষ ও জগৎকে গভীরভাবে জানার মাধ্যমে।’

সঙ্গীতের ভেতর থাকতে ভালোবাসেন চঞ্চল ।
সঙ্গীতের ভেতর থাকতে ভালোবাসেন চঞ্চল ।

একটু ক্ষোভ নিয়ে আলাপচারিতার আরেক পর্যায়ে বললেন, ‘অসুস্থতার পর অনেক মানুষ দেখেছি। অনেক লোকের চেহারা চিনেছি। খুব কম সংখ্যক মানুষই ভালোবেসে আসলে পাশে থাকে। না হলে সব নিজের সুবিধা ও স্বার্থ আদায়ের জন্য তোয়াজ করতে ব্যস্ত। যারা আমার রিসেপশনে এসে বসে থাকত কাজের জন্য, তারা অনেকে সেই কৃতজ্ঞতাটুকুও প্রকাশ করে না। আবার অনেকেই রয়েছে, যারা এখনো ভীষণভাবে ভালোবাসে। সবকিছুর পরে বলব, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।’

আমাদের আড্ডা এতটাই জমে উঠেছিল, কথা বলতে বলতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, টেরই পাইনি। এবার আমার বিদায়ের পালা। কদমবুসি করে বেরিয়ে এলাম তাঁর বাসা থেকে। পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, চঞ্চল মাহমুদদের শিল্পীসত্তা বেঁচে থাক আজীবন। পেছনে না হেঁটে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো এগিয়ে যাক বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি জগৎ।

চঞ্চল মাহমুদের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে আমি।
চঞ্চল মাহমুদের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে আমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments