– ইমন চৌধুরী
কাল নাদিয়ার বিয়ে। আজ গায়ে হলুদ। নাদিয়া আমার প্রেমিকা। মানে প্রাক্তন প্রেমিকা। একসময় ছিল। এখন আর নেই। আমাদের সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চুকে-বুকে গেছে। আমরা আমাদের এই পরিণতির জন্য কেউ কাউকে অভিযুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মজার ব্যাপার, নাদিয়া আমাকে তার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছে। দিন সাতেক আগে দেখা করে নিজ হাতে কার্ড দিয়ে গেছে। আমি কার্ডটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম শব্দহীন। নাদিয়াও নিশ্চুপ ছিল সে সময়। তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। টিএসসির সামনের রাস্তায় বসেছিলাম আমরা। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। শহরের বাতিগুলো জ্বলে উঠছিল একের পর এক। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলেছিল নাদিয়া, ‘যদি সম্ভব হয় এসো বিয়েতে। আমার ভালো লাগবে। তুমি তো খুব প্র্যাকটিক্যাল। আসতেই পারো।’
‘হুম, দেখি, সময় পেলে আসতেও পারি।’ আমি গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছিলাম।
‘সময় পেলে! তার মানে নাও আসতে পারো, এই তো?’
‘যদি হঠাৎ কাজ পড়ে যায়, কিছু তো করার নেই।’
‘হুম, তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা তোমার নীল পাঞ্জাবিটা আছে তো?’
‘আছে।’
‘অনেক দিন হলো পরো না। এলে পাঞ্জাবিটা পরে এসো। তোমাকে নীল পাঞ্জাবিতে ভালো দেখায়।’
নাদিয়ার কথা শুনে আমার হাসি পেয়েছিল। আজকাল হাসি খুব কম পায়।
‘হাসছো যে?’
‘এমনি।’
‘একটা কথা রাখবে?’
‘বলো।’
‘যদি আমার বিয়েতে আসো তবে প্লিজ কোনো গিফট আনবে না সঙ্গে।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
আমার ধারণা, আমি নাদিয়াকে মোটামুটি বুঝতে পারি। দীর্ঘ চার বছর আমরা প্রেম করেছি। ঝরে পড়া একটি দেবদারুর পাতা হাতে তুলে নিতে নিতে বলেছিলাম, ‘চিন্তা করো না। একটা গিফট কিনতে আর কত টাকা লাগবে? বেশি দামি গিফট তো দিতে পারব না। আমার সাধ্যের মধ্যেই দেবো।’
শুনে নাদিয়া চুপ হয়ে গিয়েছিল। আমার কথাও যেন ফুরিয়ে এসেছিল। বুকের ভেতর শূন্য শূন্য লাগছিল সে সময়। ঝুপ করে চারদিকে নেমে এসেছিল পোড়া মবিলের মতো সন্ধ্যার নিবিড়, ঘন অন্ধকার। এমন নিবিড়, ঘন কত সন্ধ্যা আমরা কাটিয়েছি একসঙ্গে। কখনও আমার একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের কোলের ওপর রেখেছে নাদিয়া। কখনও আমি টেনে এনেছি নাদিয়ার শুভ্র দুটি হাত। তারপর আমাদের আঙুলগুলো অস্থির হয়ে উঠত ভালোবাসার গভীর স্পর্শে। সেসব এখন কেবলই স্মৃতি। অতীতকাল।
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাদের একসঙ্গে কাটানো শেষ সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে এটি। প্যান্টের পকেটে হঠাৎ মুঠোফোনটা চেঁচিয়ে উঠেছিল। একবার, দু’বার। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছিল না আমার।
‘ফোনটা ধরো।’ ধমকের সুরে বলেছিল নাদিয়া। আমাকে ধমক দেওয়ার অধিকার কি এখনো আছে নাদিয়ার? থাকার কথা নয়। আমি নিরস কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলাম, ইচ্ছে করছে না।’
‘আজব তো! ফোন ধরবে না কেন? জরুরি ফোনও তো হতে পারে। নাকি বিশেষ কারও ফোন! আমার সামনে রিসিভ করতে অসুবিধা হচ্ছে?’ বলতে বলতে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল নাদিয়া।
মেয়েদের বোঝা খুব কঠিন। মেয়েরা সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মতো রহস্যময়। খানিকটা আলো, খানিকটা অন্ধকার মিলেমিশে একাকার। বোঝা যায় না, পড়া যায় না। ছেলেরা দিনের আলোর মতো। সবটুকু দেখা যায়। পড়াও যায় দিব্যি। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবারও মুখ খুলেছিল নাদিয়া, ‘অসুবিধা নেই, বিশেষ কারও হলেও ধরতে পারো আমার সামনে। তোমার জীবনে এখন যে কেউ আসতে পারে। আমার বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার নেই এখন আর।’
‘চা খাবে?’ প্রসঙ্গ বদলাতে চেয়ে বলেছিলাম আমি।
‘খাওয়া যায়। লেবু চা।’
‘আমি জানি।’ পাশেই টিএসসির ভাসমান চায়ের দোকানে দু’কাপ লাল চায়ের নির্দেশ দিয়ে আবারও আলোচনায় ডুব দিয়েছিলাম আমরা। নাদিয়া হঠাৎ আমার ডান হাতটা চেপে ধরেছিল আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে। আর্দ্র কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার ওপর কোনো অভিমান রেখো না, প্লিজ।’
‘কী বলছ! অভিমান রাখতে যাব কেন? আমরা দুজন অনেক ভেবেই ব্রেকআপের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সামনে তো অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই। তুমিও অনেক সময় দিয়েছ আমাকে। কিন্তু কত দিন অপেক্ষা করবে। আমার জীবন একটা অনিশ্চয়তার জীবন। মাথার ওপর বাবার ছায়া নেই, চাকরি নেই, এই শহরে থাকার স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই- এই অনিশ্চয়তার মধ্যে তুমি কেন নিজেকে জড়াবে! এর মধ্যে তুমি অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব ঠেকিয়ে দিয়েছ। কিন্তু আর কত? আমার কোনো অভিমান নেই। আমি বাস্তবতাটা বুঝতে পারছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বুঝেশুনেই নিয়েছি। আমাদের দুজনের ভালোর জন্যই নিয়েছি।’
‘তবুও!’
‘মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা রেখো না। দেড় বছর সময় তো কম না। তোমার দেওয়া এই সময়টুকু আমি কাজে লাগাতে পারিনি। চেষ্টা অবশ্য কম করিনি। কিন্তু হয়নি। আমার বড় কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই যে সুপারিশ করবে। রেজাল্টও ব্রিলিয়ান্ট কিছু হয়নি। কল সেন্টার, মার্কেটিং-এসব জায়গায়ও চাকরি করে দেখেছি। যে বেতন ওরা দিতে চায়, তাতে আমার একারই হয় না। তাই ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। অথচ তোমার জন্য একের পর এক ভালো ভালো প্রস্তাব আসছে। তোমার জায়গায় আমি হলেও একই কাজ করতাম। আমরা তো স্কুল-কলেজে পড়ি না। আমার মনে হয়, আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি।’
সন্ধ্যার অন্ধকার তীব্র থেকে আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল ততক্ষণে। আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম আরও বেশ কিছুক্ষণ সময়। একসময় বিদায় নিয়েছিল নাদিয়া। শেষবারের মতো। পাখির মতো রেখে গিয়েছিল স্মৃতির পালক। নাদিয়ার বিয়ের কার্ডটি হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো। নির্বাক।
আমার কি নাদিয়ার বিয়েতে যাওয়া উচিত! গত সাত দিন ধরে অনেক ভেবেছি। তবুও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমি নাদিয়ার বিয়ের কার্ডটি নেড়েচেড়ে দেখি। বর ও কনের নাম পড়ি বারবার। গত সাত দিন ধরে কতবার যে পড়েছি ও দেখেছি, তার হিসাব নেই। বেশ সুন্দর কার্ড। বেশ দামিও।
আচ্ছা, বিয়েতে গেলেই বা এমন কী হবে! কেউ তো আমাকে চিনতে পারবে না। চুপচাপ খেয়ে চলে আসব। দূর থেকে নাদিয়াকে একবার দেখব। বউ সাজলে ওকে কেমন দেখায়, সেটাও দেখা হয়ে যাবে। প্রেমিকার বিয়েতে নিমন্ত্রণ! একটা নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। একটু কি কষ্ট হবে! হতে পারে। হলে হবে। অনেক বড় বড় কষ্টও তো এই এক জীবনে হজম করে ফেলেছি। না হয় কষ্টের সংখ্যা আরেকটি বাড়বে।
পরদিন সন্ধ্যায় অনেক ভেবে নীল পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি নাদিয়ার বিয়ে খেতে। রামপুরার একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান। আমার হাজির হতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। এর মধ্যে ভোজন পর্ব শুরু হয়ে গেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জীবনের এই নতুন অভিজ্ঞতা আমি খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করব। পেট ভরে খাবো। ঘুরে ঘুরে দেখব বিয়ের আয়োজন। নাদিয়ার বরকেও একবার দেখার ইচ্ছে আছে। সঙ্গে নাদিয়াকেও। একসময় বউয়ের সাজে ওকে দেখার খুব স্বপ্ন দেখতাম। এখন দেখি না। অর্থহীন স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তবুও যখন এসে পড়েছি, বউয়ের সাজে নাদিয়াকে একবার দেখেই যাই।
তার আগে খাবারটা সেরে নেওয়া যাক। মোটামুটি বড় আয়োজনই করেছেন নাদিয়ার সরকারি কর্মকর্তা বাবা মশিউর রহমান। প্রচুর অতিথি। চারদিকে গিজগিজ করছে জমকালো পোশাক আর ভারী মেকআপে ঢাকা নারীরা। তরুণ ও তরুণীরা। এখানে কেউ আমাকে চিনে না। আমিও কাউকে চিনি না। আমাকে যে চেনে সে আজ এই আয়োজনের মধ্যমণি। তার আজ অনেক ব্যস্ততা। অতিথিরা খাওয়ার জন্য বসে পড়েছেন। আমি ফাঁকা চেয়ার খুঁজতে থাকি। একপাশে মোটামুটি একটা ফাঁকা টেবিল পেয়ে টুপ করে বসে পড়ি। ততক্ষণে হইহই করে আমার পেছনে এসে দাঁড়ায় কয়েকজন তরুণ-তরুণী। ছয়জনের টেবিলটিতে আগে থেকেই দুজন বসা ছিল। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও চারজন। ওরা একসঙ্গে বসতে চায়। আমি বেরসিকের মতো ওদের মাঝখানে বসে পড়েছি। বিষয়টা বুঝতে পারছিলাম আমি। আমার কি এখন উঠে যাওয়া উচিত? আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে পাশে বসা তরুণীর সুরেলা কণ্ঠে, ‘কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। আমরা আসলে একসঙ্গে বসতে চাচ্ছিলাম। আপনি যদি পাশের টেবিলে বসতেন।’
এরপরও বসে থাকাটা শোভন দেখায় না। আমি সম্মতির হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে উঠে পড়ি। কিন্তু ততক্ষণে পাশের টেবিলসহ সব টেবিল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। কোনো ফাঁকা চেয়ার খুঁজে না পেয়ে দ্বিতীয় পর্বের জন্য একপাশে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। মিনিট পাঁচেক বাদেই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করল নাদিয়া। বিয়ের সাজে ওকে আজ অন্য রকম লাগছে। উদ্ধত রাজহংসীর মতো। সদ্য ফোটা ফুলের মতো। এই নাদিয়া আমার অচেনা। আমি খানিকটা আড়ালে চলে যাই। কিছুতেই যেন আমাকে দেখতে না পায় নাদিয়া। আমার কি একটু কষ্ট হচ্ছে! বুকের ভেতর একটু চিনচিনে ব্যথা! একটা শূন্যতার ভেতর কি আমি তলিয়ে যাচ্ছি! আচ্ছা, নাদিয়ার কি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে! ওকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। নাদিয়া হাসছে, কথা বলছে, ছবি তুলছে। সবকিছুই স্বাভাবিক। তবে আমি কেন কষ্ট পাব! কেন! আমি নাদিয়ার কাছ থেকে দূরে সরতে সরতে ওর দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে চলে যাই।
এর মধ্যে প্রথম পর্বের খাবার শেষ। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে সবাই চেয়ার দখল করছে। আমি বরাবরই বাস্তববাদী মানুষ। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে দ্বিতীয় পর্বের খাবারের প্রতি নিতে শুরু করি। এবার সবার শেষের দিকে একটি সম্পূর্ণ ফাঁকা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ি। একসঙ্গে বারোজনের খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এই টেবিলে। হঠাৎ একটা শোরগোল। একজন লোককে জটলা করে ঘিরে ধরেছেন অনেকে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দেখার চেষ্টা করি। দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এসেছেন। দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না আমার। নাদিয়ার মুখে কয়েকবার শুনেছি। এই মন্ত্রী সম্পর্কে নাদিয়ার মামা হন। নাদিয়ার মায়ের খালাতো ভাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর আগমন। বিরাট ব্যাপার! আমি যেন আরও গুটিয়ে যাই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও চেয়ারে বসে পড়ি। খাবো কি খাবো না ভাবতে থাকি। এর মধ্যে বয় গোছের একজন দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখানে মন্ত্রী স্যার বসবেন তার লোকজন নিয়ে। প্লিজ স্যার, কিছু মনে করবেন না, কষ্ট করে আপনি অন্য কোনো টেবিলে বসুন।’ বয়-এর মুখে মন্ত্রীমশাইও স্যার, আমিও স্যার। এত বিষাদ, এত অপমানের মধ্যেও খানিকটা সুখ অনুভব করলাম।
সত্যি বলতে কি, মন্ত্রী মশাইকে দেখে আমি এ রকমই আশঙ্কা করছিলাম। আশপাশে সব টেবিল ঘিরে লোকজন বসার পরও এই টেবিলটা কেন ফাঁকা রাখা হয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলো না আর। আমি আবারও মাথা নেড়ে উঠে পড়ি। আশপাশের টেবিল ততক্ষণে পূর্ণ হয়ে গেছে। একজন আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে মন্ত্রীর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার আজ অপমানিত হওয়ার দিন। আমার চিন্তাশক্তি এর মধ্যে লোপ পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় পর্বের খাবারও হাতছাড়া হয়ে গেল। দ্বিতীয় পর্বই যদি খাবারের শেষ পর্ব হয়, তাহলে আজ আর আশা নেই।
এত অনিশ্চয়তা নিয়ে থাকা যায় না। আমি ধীরে ধীরে নাদিয়ার বিয়ের আসর থেকে বেরিয়ে আসি। ব্যস্ত সড়ক ধরে হাঁটতে থাকি ক্রমাগত। একবার মনে হলো, হাঁটতে হাঁটতে এই জনপদ পেরিয়ে চলে যাই দূরে কোথাও।
প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটার পর পায়ের জোর খানিকটা কমে এলো। কিছুটা ক্লান্তি ভর করল শরীরে। এতক্ষণে পেটের ক্ষিধেটাও টের পেলাম। ভেবেছিলাম, নাদিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে পেট ভরে রাতের খাবারটা সেরে নেব। সে আর হলো না। রাস্তার পাশে একটা সস্তা খাবার হোটেলে ঢুকে পড়ি। হোটেলে খদ্দের বেশি নেই। একজন অটোরিকশা চালক চেয়ারে এক পা তুলে আয়েশি কায়দায় বসে খাচ্ছেন। আমি তার পেছনের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম টুপ করে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে সামনে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করি আমি। স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। নড়বড়ে টেবিল, সঙ্গে টানা বেঞ্চ। আমার ডান পাশেই আরেকটা ছোট বেঞ্চে বসে আছে ক্লান্ত এক কিশোরী। বয়স তেরো কি চৌদ্দ হবে। পনেরোও হতে পারে। মনে হচ্ছে হোটেলের কর্মচারী। মধ্যবয়স্ক মহিলাটির মেয়েও হতে পারে। আমি মহিলার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললাম, ‘ভাত।’
একটা আটপৌর প্লেটে আমার খাবার হাজির হলো। সঙ্গে ছোট একটা বাটিতে এক টুকরো রুই মাছ। আমি গোগ্রাসে গিলতে গিলতে নাদিয়ার কথা ভাবি। এতক্ষণে কি বিয়ে হয়ে গেছে নাদিয়ার? হয়ে যাওয়ারই কথা। হঠাৎ চোখ পড়ল, সামনে বসা ক্যাশিয়ারের ওপর। বয়স্ক একজন লোক। ক্ষয়ে যাওয়া শরীর। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। হঠাৎ খেয়াল হলো, লোকটার একটা হাত নেই। এক হাতেই দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছেন জীবনটা। আরেকটা ছোট বাটিতে বুড়িগঙ্গার ঘোলা পানির মতো একটুখানি ডাল নিয়ে আবারও আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিলা। আমি কৌতূহল দমাতে না পেরে জানতে চাইলাম, ‘উনি কে হন আপনার?’
‘আমার স্বামী।’
‘কী হয়েছিল উনার? হাতটা কীভাবে গেল?’
‘চামড়ার কারখানায় কাম করত। মেশিনে কাটা পড়ছে।’ কেমন নির্বিকার শোনায় মহিলার কণ্ঠ। যেন মেশিনে হাত কাটা পড়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার!
‘হুম, আপনাদের বিয়েটা কীভাবে হলো?’ আমাকে যেন হঠাৎ গল্পের নেশায় পেয়ে বসল।
‘আমি উনাগো মেসে ভাত রানতাম। একসঙ্গে অনেকজন থাকতেন। হঠাৎ মানুষটার হাত কাটা পড়ল কারখানায় কাম করতে গিয়া। কেমন অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকত। দেখে খুব খারাপ লাগত!’ মহিলা চুপ হয়ে গেলেন। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘তার মানে উনার হাত কাটা যাওয়ার পর আপনাদের বিয়ে হয়েছে!’
‘হ রে বাপ!’
‘কী আশ্চর্য! একটা হাত নাই দেখেও বিয়ে করে ফেললেন!’ আমার বিস্ময় কিছুতেই কাটতে চায় না।
‘মানুষটার মনটা খুব ভালা। দেখে মায়া পইড়া গেছিল।’
আমি চুপ হয়ে যাই হঠাৎ। আমার আর কিছু জানতে ইচ্ছে করে না। আমার তো দুইটা হাতই ছিল। কই, নাদিয়ার তো তবু মায়া হয়নি আমার জন্য! না হয় বেকারই ছিলাম। না হয় চলার মতো একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে আরও দু-এক বছর লাগত! একজন মানুষ তো চিরকাল বেকার থাকে না। আর কয়েকটা দিন কি লড়াইটা চালিয়ে যেত পারত না নাদিয়া! আর কয়েকটা দিন। কিংবা বলতে পারত না, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি! নাদিয়ার পিছুটান দেখেই তো আমাকে ভালোবাসার দাবি ছেড়ে দিতে হলো।
নাহ, আমার এই অভিমান এখন অর্থহীন। খাবার সেরে আমি উঠে পড়ি। বিল দিতে গিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে হাত চালাতেই টাকার সঙ্গে বেরিয়ে এলো একজোড়া রুপার নূপুর। পায়ে নূপুর পরতে খুব পছন্দ করে নাদিয়া। ওর বিয়েতে উপহার দেবো বলে কিনেছিলাম। দিতে ভুলে গেছি। খাবারের বিল মেটাতে মেটাতে মধ্যবয়স্ক মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ক্লান্ত কিশোরীকে কাছে ডাকলাম। গুটি গুটি পায়ে মেয়েটা কাছে আসতেই নূপুর জোড়া তুলে দিলাম ওর হাতে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হাতের তালুতে নিয়ে নূপুরজোড়া দেখতে থাকে মেয়েটি। ধীরে ধীরে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটের কোণে। আমি আর দাঁড়াই না। রাত হয়েছে অনেক। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।