সিরাজ উদ্দিন আহমেদ
(মাঝে মাঝে মনে হয়, এ জীবন আমার নয়। অন্য কাহারও জীবন আমি করিতেছি বহন।)
নমিতা বলল, ‘আমরা তাজমহল দেখতে যাব।’
আমি বিব্রত বোধ করি। নমিতা আমার নববধূ।
দুদিন হয় আমাদের বিয়ে হয়েছে। নমিতার স্বপ্ন, তার এই উদ্ভাসিত আনন্দ ম্লান হয়ে যাক, সে আমি চাই না। অক্ষমতা আমাকে ছোট করে দেয়। নমিতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আমি মৃদুস্বরে বলি, ‘যাব, নিশ্চয়ই যাব।’
নমিতা অবাক হয়ে বলল, ‘ওমা, তুমি কি আগ্রার
তাজমহলের কথা বলছ?’
‘পৃথিবীতে তাজমহল একটিই আছে। আগ্রার
তাজমহল। আর কোনো তাজমহল আছে নাকি?’
নমিতা হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘আছে মশাই। আমাদের গ্রামেও একটি তাজমহল আছে। সেখানে আজ বিকেলে তোমাকে নিয়ে যাব। তোমার ভালো লাগবে।’
আমার মনে হলো, গ্রামের কোনো ধনী লোক তার
বাড়িটি তাজমহলের মতো করে বানাতে চেষ্টা করেছে। বাড়ির নামও দিয়েছে হয়তো বা তাজমহল। বাইরের কেউ বেড়াতে এলে গ্রামের লোকজন গর্বের সঙ্গে দেখায়, ‘এই দেখ, আমাদের তাজমহল!’
‘সে কেমন? আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করি, আগ্রার তাজমহলের মতো?’
‘না। একেবারে আলাদা।’ নমিতা থেমে পড়ল। ‘এখন বলা যাবে না। বললে রহস্য থাকবে না। তুমি
নিজের চোখে দেখবে।’
নমিতা আমার কাছে সরে এলো। হাত ধরে সকরুণ নয়নে আমার দিকে তাকাল। মৃদু স্বরে বলল, ‘তাজমহলের কথা শুনে তোমার মুখ কালো হয়ে গেল। আমাকে কি এত অবিবেচক মনে হয়? তোমার এ অবস্থায় আমি তাজমহল দেখার বায়না করব। হঠাৎ করে আমাদের বিয়ে হলো। তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ জানে না। কত কথা শুনতে হবে! কত ঝড়-ঝাপ্টা যাবে। আমি কিন্তু তোমার হাত ছাড়ব না। সবকিছুর জন্য আমি তৈরি হয়ে আছি। তুমি একদম টেনশন করবে না। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
নমিতার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। আমি পেইন্টার। বয়স চব্বিশ। চারুকলার ছাত্র ছিলাম। পড়াটা শেষ করতে পারিনি। পড়া ছেড়ে রোজগারের জন্য পথে দাঁড়ালাম। ছবিটবি আঁকি। বেশির ভাগ ওয়াটার কালার ল্যান্ডস্কেপ। চারুকলার ফুটপাতে ছবি সাজিয়ে দাঁড়াই। শাহবাগে ধানমণ্ডির কয়েকটি দোকানে পেইন্টিং দেয়া আছে। বিক্রি খারাপ হয় না। আমার পেইন্টিংয়ের দাম কম। এক হাজার টাকা হলে ৩০×২০ ইঞ্চি সাইজের আমার একটি ল্যান্ডস্কেপ বাংলার নিসর্গ আপনার ড্রইং রুমে ঝুলাতে পারেন।
ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে আমি মাঝেমধ্যে ঢাকার আশেপাশের গ্রামগুলিতে যাতায়াত করি। রথমেলার ছবি আঁকতে আমি ধামরাই চলে গেলাম। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। রথের চারপাশে মেলার আঙিনায় সার্কাসের হাতি ঘোড়ায় জনমানুষে জলে- কাদায় একাকার। আমার ভালো লাগল না। আমি ব্রিজ পার হয়ে চলে গেলাম কুমার পাড়ায়। নদীর ধারে একটা নিরিবিলি জায়গায় দিনভর ছবি আঁকলাম। জল-কাদায় মাখামাখি হাতি-মানুষে গলাগলি রথের মেলার ছবিও এঁকেছি। বিকেল বেলায় ক্ষুধায় কাতর হয়ে কাছেই একটা টঙের দোকানে গেলাম খেতে। কলা-পাউরুটি-চা খাচ্ছি, দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘ঢাকা থেইকা আইছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঢাকায় ফিরে যাবেন?’
আমি একটু অবাক হলাম, ‘হ্যাঁ। কেন?’
দোকানদার বলল, ‘মনে হয় ঢাকায় আইজ ফিরতে পারবেন না। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গাবতলীর দিকে কী নাকি গোলমাল হইছে।’
‘তাহলে উপায়?’ আকাশে ঘনঘোর বর্ষা। যেকোনো সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি হবে। আমি শঙ্কিত দৃষ্টিতে আকাশ দেখি।
‘ভাই, এখানে আজ রাতটুকু থাকার মতো কোন ব্যবস্থা আছে? কোনো হোটেল বা অন্য কিছু…।’
‘গ্রামেগঞ্জে হোটেল পাইবেন কই? আপনে এক কাজ করেন, সুবল পালের বাড়ি চলে যান। তারা
ভাল মানুষ। তাগো বাড়ির পোলাপান স্কুল কলেজে পড়ে। শিক্ষিত মানুষের কদর বুঝে। সে সাহায্য করতে পারে।’
আকাশ ঘন কালো, জোর বাতাস বইছে। লোকটি দোকান বন্ধ করতে করতে বলল, ‘দোকান বন্ধ কইরে আমি বাড়ি যাব। আপনি রওনা হইয়া যান।’
আমি ব্যাকুল হয়ে বলি, ‘সুবল পালের বাড়ি আমি চিনব কী করে?’
‘পাল পাড়ায় একটাই দোতলা বাড়ি। সেটাই সুবল পালের বাড়ি। এইখান থেইকা দেখা যায়। ওই যে নারিকেল গাছওয়ালা দোতলা বাড়িটা দেখতাছেন ওইটা সুবল পালের বাড়ি।’
আমার ছবি আঁকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়ে দোতলা বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
ঘরের দরজা খুলে একজন তরুণী বলল, ‘বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? ভেতরে এসে বসুন।’
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। তবু বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’
মেয়েটি হাসল, ‘আপনি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।’
বাতাসে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে। আমি ছবি আঁকার সরঞ্জাম ঘরের এককোণে রেখে মেয়েটির দিকে তাকালাম। আমি স্বপ্নে মাঝে মাঝে একটি মেয়েকে দেখি।
মেয়েটির চেহারা মনে নেই। আচরণ মনে আছে। মেয়েটি কোমল গলায় আমাকে নির্দেশ করে। আমি নীরবে পালন করি। এড়াতে পারি না।
মেয়েটি বলল, ‘বসেন।’
আমি বসলাম। মেয়েটি কি আমার স্বপ্নে দেখা তরুণী, যাকে আমি চিনি না কিন্তু নির্দেশ পালন করি?
দুকাপ চা নামিয়ে রেখে আমার মুখোমুখি বসে বলল, ‘নিন, চা খান।’
আমি চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলে নিলাম।
‘আপনি আর্টিস্ট?’
‘আমি পেইন্টার। ছবি আঁকি।’
ভাবলাম এই সুযোগে আমার বিপদের কথাটা বলি। এ পর্যন্ত আচরণে মেয়েটিকে হৃদয়বতী মনে হয়েছে।
হয়তো সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। আমি মেয়েটিকে বলত যাবো অমনি মেয়েটি বলল, ‘আপনার তো বিপদ হলো। এ বৃষ্টিতে ফিরবেন কী করে?’
আমি শঙ্কিত গলায় বললাম, ‘তাই তো ভাবছি।’
মেয়েটি বলল, ‘আপনার যাওয়া হবে না।’
আমি সভয়ে বলি, ‘কেন?’
মেয়েটি আকাশের দিকে তাকাল, ‘আকাশের অবস্থা দেখেছেন?’ এ বৃষ্টি থামার নয়।
আমি মেয়েটির মুখপানে অসহায় তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে?’
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কী আছে! যেতে না পারলে থেকে যাবেন।’
আমি চমকে উঠি, কোথাও কি কোন ভুল হচ্ছে?
একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে মেয়েটি চেনা মানুষের মতো কথা বলছে। আমাকে নির্দ্বিধায় যেভাবে ঘরে ডেকে নিল, আমার আসাটা যেন পূর্বনির্ধারিত। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। গ্রামের একটি মেয়ের এমন দ্বিধাহীন নিঃসংকোচ
আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে। ভয়ও করছে। কোনো
বিপদ হবে না তো?
আমি বারান্দায় বেরিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বৃষ্টির
গতিবেগ দেখে হতাশ হলাম। অঝোর ধারায় বৃষ্টি
ঝরছে। মেয়েটি বলল, বারান্দায় দাঁড়ালে ভিজে
যাবেন। ঘরে এসে বসুন।
আমি ঘরে ফিরে এলাম।
মেয়েটি বলল, আমার জন্য কি আপনি অস্বস্তি
বোধ করছেন?
সহজ হতে চেয়ে আমি মৃদু হাসলাম, না। তা হবে কেন! বাসায় কে কে আছেন?
মেয়েটি বলল, আমার বাবা গত হয়েছেন। আমার তিন দাদা। দাদারা বাইরে আছেন। বাসায় বৌদি আছেন, মা আছেন। কথা বলবেন?
মেয়েটির দিকে সাহস নিয়ে তাকাই। ভারি মিষ্টি তো মেয়েটি! প্রতিমার মত। ডাগর সজল চোখ। তাকিয়ে থাকলে হৃদয়ে কাঁপন জাগে। চোখ সরিয়ে আমি আকাশ দেখি। মুষলধারার বর্ষণ ছাড়া দেখার কিছু নেই। তবুও সেদিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটির দিকে তাকাতে ভয় হয়। প্রথমত, মেয়েটি সুন্দরী। দ্বিতীয়ত, রহস্যময়ী।
একা থাকতে ভয় পাবেন না তো? মেয়েটি নিঃশব্দে হাসল। মেয়েটি যখন হাসে তাঁর চোখও হাসে। আমি ভেতর বাড়ি যাচ্ছি। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আমার নাম নমিতা।
নমিতা দ্রুত বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। কতক্ষণ আর একনাগাড়ে ঠাঁই বসে থাকা যায়। আমি উঠে পায়চারি করলাম। ভেতর বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। অন্ধকারে বৃষ্টির পর্দায় সব ঢাকা পড়ে আছে। শুধু ঘরগুলোর আলো দেখা যায়। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। অসহায় বন্দির মতো আকাশে তাকিয়ে রইলাম।
‘বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন যে!’
আমি এত চমকে উঠলাম যে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। সভয়ে নমিতার দিকে ফিরে তাকালাম। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আগে কামিজ পরে ছিল, এখন দেখছি শাড়ি পরেছে। কিছু সাজসজ্জাও করেছে। কপালে টিপ দিয়েছে। চোখে কাজল টেনেছে। নমিতাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে।
‘সরি!’ নমিতা সরি বলল কিন্তু ঠোঁটে ঝুলে থাকল রহস্যময় হাসি। আমার মনে হলো আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে চলে যেতে পারেন। তাই বলতে এলাম। এ কাজ করবেন না। বিপদে পড়বেন। দেখছেন না কেমন বৃষ্টি। সকালের আগে এ বৃষ্টি
থামবে না।
ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো কথাগুলো বলে রহস্যময়ী নমিতা বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার আস্থা দুর্বল হতে থাকে। নমিতা আমার মনের কথা জানল কী করে? আমি পালাতে চাই। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। আঁকা ছবি ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম রেখে প্রবল বর্ষণের মধ্যে গোপনে আমি পথে নেমে এলাম। মন বলছে বাঁচতে হলে পালাতে হবে। ভবিতব্য বলছে যতই পালাও, যাবে কোথায়? গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।
তীব্র বৃষ্টির তীক্ষ্ণ ফোঁটা আমার শরীরে বিঁধছে। প্রবল হাওয়া আমার গতি টেনে ধরেছে। এসব উপেক্ষা করে আমি প্রাণপণে এগিয়ে যাচ্ছি।
তিনজন লোক আমার গতি রোধ করে দাঁড়াল। আমার মনে হলো, এরা নমিতার তিন দাদা। আমাকে ধরতে এসেছে। আমাকে পালাতে হবে। আমি যত দ্রুত পালাতে চাই, পা পিছলে বারবার পড়ে যাই।
নমিতা ওদের বাড়ি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।
বাড়ির একপাশে বিশাল দোচালা ঘর। সেখানে নানা আকারের দেবদেবীর মূর্তি।
‘এগুলো কে বানিয়েছে?’
‘আমার দাদারা।’
‘তুমি বানাতে পার?’
‘পারি। মূর্তি বানাতে দাদাদের আমি সাহায্য করি।’
‘কী সুন্দর নিখুঁত মূর্তি বানাও তোমরা। আমাকে
শেখাবে?’
‘শেখাব।’
দুর্গা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হলাম। তারপর অভিভূত, বিস্মিত, অবশেষে আতঙ্কিত। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, ‘নমিতা..।’
নমিতা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘কী হয়েছে?’
আমি দুর্গাদেবীর দিকে আঙুল নির্দেশ করি, ‘দ্যাখো, তোমার মতো দেখতে। অবিকল তোমার মতো। তুমি দুর্গা?’
‘হ্যাঁ আমি। আমিই তো। আমিই দুর্গা।’
রাজহাঁসের পিঠে বসে সরস্বতীর বীণা হাতে নমিতা আমাকে দেখছে!
লক্ষ্মীর দিকে তাকাই। পেঁচা কোলে নমিতা। আমাকে বোকা বানাতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসছে।
কালীর দিকে তাকাতে আমার ভয় হয়।দুহাতে
আমি চোখ লুকিয়ে রাখি। নমিতাকে কালী রূপে
আমি দেখতে চাই না।
নমিতা বলল, ‘কী হলো, আমাকে দেখবে না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘ভয় করে।’
‘আমি যেমন প্রলয় তেমনি সৃষ্টিও করি। সৃষ্টিতে
তুমি পাশে থাকবে, প্রলয়ে কেন থাকবে না। তাকাও, আমাকে দেখ।’
‘আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম। নগ্ন নমিতা আমার
বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ক্রুদ্ধ খড়গ।
কামড়ানো জিহ্বায় অনুতপ্তের চিহ্ন। আমি জ্ঞান হারালাম।
কেউ বলল, ‘তাড়াতাড়ি যাও। ডাক্তার নিয়ে এসো।’
‘আমার কী হয়েছিল?’
নমিতা বলল, ‘আজ দশ দিন পর তুমি ঘর থেকে
বেরুলে। তুমি অসুস্থ ছিলে। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান
হারাচ্ছিলে।’
‘তুমি কি ডাক্তার?’ জ্বরের ঘোরে তোমাকে একবার দেখেছি। ডাক্তারের এপ্রোন পরা। আমার জ্বর দেখছো। ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছ।
তনিমা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি নার্স। দুদিনের মধ্যে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বাড়িতে ফিরে
যেতে পারবে।’
আমি নমিতার হাত ধরি, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি
কোথাও যাবো না। আমাকে তাড়িয়ে দিও না, প্লিজ।’
পরদিন নমিতা সঙ্গে আমার বিয়ে হলো।
বিকেল হতে নমিতার সঙ্গে রিকশায় আমি তাজমহল দেখতে রওনা হলাম। তাজমহল দেখার চেয়ে নমিতার সঙ্গে রিকশায় ঘনিষ্ঠ ভ্রমণআমার কাছে অনেক আনন্দ ও রোমাঞ্চকর ছিল। নমিতা অন্যমনস্ক, চিন্তিত। আমার রোমাঞ্চ তাকে স্পর্শ করল না। ভিন্ন উত্তেজনায় সে উদগ্রীব হয়ে আছে। চারিদিকে তাকিয়ে আমি হতাশ হলাম, ‘এই তোমার তাজমহল! এটা দেখার জন্য কত কথা,
কত আয়োজন।’ নমিতা ভ্রূ-কুঁচকে তাকাল, ‘এসো।’
আমি নমিতার পিছু পিছু প্রবেশ করলাম। একপাশে ঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠোন। অন্য পাশে পাশাপাশি দুটি কবর। একটি বদ্ধ অন্যটি খোলা। কবরের ওপর সবুজ কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো। পাশে সাদা দাড়ি-গোঁফে জট পাকানো সুদর্শন এক বৃদ্ধ প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছেন।
আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে তাকালেন। নমিতা ছুটে গেল। পায়ের কাছে মিষ্টির প্যাকেট ও ফুল রেখে প্রণাম করল।
‘মিষ্টি কেন রে বেটি?’
‘বাবা, আমরা বিয়ে করেছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’
‘বাবা, আপনি যা বলেছেন সব সত্যি হয়েছে!’
‘কী বলেছি কিছুই মনে নেইরে মা।’
পায়ের কাছে মাথা রেখে নমিতা ডুকরে কেঁদে
উঠল।
‘কাঁদছিস কেন?’
‘বাবা, আমরা সুখী হবো তো? আমার বড্ড ভয় করছে। ও মুসলমান, আমি হিন্দু। সকলে বিয়েটা
মেনে নিবে তো? ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?’
‘কে যে কীসে সুখী তা যে ভীষণ জটিল রে। তবে তোর বর তোকে খুব ভালবাসবে। তোকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তোকে হারিয়ে খুঁজে বেড়াবে
জগতময়…।’
এইসব বুজরুকি আমার ভাললাগে না। নমিতা কষ্ট পাবে ভেবে আমি নিরব থাকি। নমিতার মন
ভার হয়ে আছে। সারাটা পথ সে কোন কথা বলেনি।
রাতে শোবার আগে নমিতাকে হাসিখুশি লাগছে, তখন জানতে চাইলাম, দুটা করব দেখলাম। একটি খোলা অন্যটি ঢাকা। এর রহস্য কী?
নমিতা বলল, ঢাকা কবরে শায়িত আছেন মমতাজ বেগম। খোলা কবরে ঘুমান শাহজাহান।
বিকেলে যাঁর কাছে আমরা গিয়েছিলাম। মৃত্যুর পর মমতাজ বেগমের পাশে তাঁর কবর হবে। তাই
আমরা এই মাজারকে বলি তাজমহল।
আমি শব্দ করে হেসে উঠি, ‘মজা করছো?’
নমিতা দৃঢ় চিত্তে বলল, ‘সত্য বলছি।’ নমিতার
চোখে মুখে আমি রঙ্গ-রসিকতার কোনো চিহ্ন
দেখলাম না।
আমি বললাম, ‘অনেক স্বামী-স্ত্রীর নাম শাহজাহান-মমতাজ হতে পারে। তাহলে সবার কবরই কি তাজমহল?’
নমিতা কিছু বলল না।
সকালবেলা নমিতা বলল, ‘মমতাজ বেগম শাহজাহানের স্ত্রী ছিলেন না। প্রেমিকা ছিলেন।’
‘সম্রাট শাহজাহানের কথা বলছ?’
‘না, আমাদের গ্রামের প্রেমিক শাহজাহানের কথা বলছি। যুবক বয়সে তিনি মমতাজকে নিয়ে
সুদূর আগ্রা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
আগ্রা থেকে ধামরাই!’ আমার হাসি পেল।
মমতাজ বেগমের স্বামীর কর্মচারী ছিলেন শাহজাহান। ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী প্রেমিকা মমতাজকে নিয়ে পালালেন শাহজাহান। প্রতিশোধের স্পৃহায় মালিকের লোক পিছু নিল।
পালাতে পালাতে অবশেষে আগ্রা থেকে ধামরাই এসে ঠাঁই মিলল। সংসার করার জন্য বাড়ি বানালেন। ফসলের জমি কিনলেন। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলো। কিন্তু বিয়েটা হলো না। ‘কেন?’ ঠিক বিয়ের মুহূর্তে মালিকের লোক প্রতিশোধ নিতে আগ্রা থেকে ধামরাই এসে হাজির হলো। ‘সিনেমার মতো হয়ে গেল না?’
সাপের কামড়ে মমতাজ বেগম মারা গেলেন। বাসর শয্যার জন্য যে ঘর সাজানো হয়েছিল, সেই ঘরে মমতাজের কবর দেয়া হলো। কবরের পাশে শয্যা নিলেন শাহজাহান। সারাদিন দোয়া-দরুদ পড়েন। কবরের পরিচর্যা করেন। আপন মনে একাকী কথা বলেন। রাত হলে কবরের পাশে শুয়ে থাকেন। এভাবে কেটেছে চল্লিশ বছর। দুবছর হয় মমতাজ বেগমের কবরের পাশে পাকা কবর করেছেন। ওই কবরে রাতে ঘুমান। এ ঘটনা
গ্রামের সবাই জানে। নমিতার মুখমণ্ডল বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন। চোখে জলজ মেঘের আনাগোনা। আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসের চেয়ে বড় নমিতার সুখ। নমিতাকে আমি কোনো কষ্ট দিতে চাই না। আমি নতমুখে নিশ্চুপ থেকে নমিতার কষ্টের অংশীদার হই। অনেকক্ষণ নীরব থেকে নমিতা জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস কর?’
আমি বললাম, ‘না। আমি কর্মে বিশ্বাস করি।’
‘আমিও করতাম না। শাহজাহান দাদুর ঘটনা
আমাদের কয়েকজন বান্ধবীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। আমরা দাদুর জন্য ফলমূল নিয়ে মাঝে মাঝে তার মাজারে যেতাম। দাদুর মন ভালো থাকলে তাঁর জীবনের গল্প শোনাতেন। আবার কখনো আমাদের তাড়িয়ে দিতেন। একদিন হাত
বাড়িয়ে আমি বললাম, দাদু, আমার ভাগ্যে কী আছে বলেন দেখি।’
দাদু বললেন, ‘আমি হাত দেখতে জানি না, মা।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে চমকে
উঠলেন, ‘তোর মনে এত কষ্ট কেন রে?’
দাদুর কথা শুনে আমার দুচোখ জলে ভরে গেল। তোমাকে তো বলেছি, ‘আমি ছিলাম লগ্নভ্রষ্টা
মেয়ে। আমাদের সমাজে লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের বিয়ে হয় না।’
দাদু হেসে বললেন, ‘চোখে পানি কেন রে?
তোর বিয়ের ফুল ফুটেছে। বিশ বছর বয়সে
তোর বর তোকে খুঁজতে খুঁজতে তোর বাড়ি এসে
হাজির হবে।’
‘তুমি যেদিন আমাদের বাড়ি এলে সেদিন ছিল আমার বিশতম জন্মদিন। বাকি ঘটনা তুমি জানো।
নমিতা আমার দিকে গভীর বিশ্বাস নিয়ে তাকাল।’
আমি বিব্রত বোধ করি। নমিতার বিশ্বাসে আমি কোনো আঘাত করতে চাই না। নমিতা ভালো গল্প বানাতে পারে। আমার দ্বিধা রয়ে গেল। মৃদু হেসে নমিতার হাতে আমার বিশ্বাস রাখলাম।এক মাস পর আমি ঢাকায় ফিরলাম। পালপাড়া গ্রামটি আমার ভালো লেগে গেল। গাছগাছালি ঘেরা নদীর ধারে গ্রাম। আমি ও নমিতা ঠিক করেছি এই গ্রামে আমরা স্থায়ী হবো। ঢাকার কাছাকাছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। আমাদের বড় স্টুডিও হবে। আমি ছবি আঁকাব। নমিতা মূর্তি বানাবে। সুখের ছবি এঁকে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকার পাট চুকিয়ে আমার এবার স্বপ্নের ঠিকানায় ফেরা। নমিতার কাছে। গোছগাছ করতে দিন পনের কেটে গেল। দোকান দোকান ঘুরে আমার ছবি বিক্রির টাকা জোগাড় করলাম। এর মাঝে অনেক পরিশ্রম করে সময় নিয়ে নমিতার একটি পোট্রের্ট এঁকেছি। আমার আঁকা প্রথম পোট্রের্ট। নমিতার বিষণ্ণ মুখ। ব্যাকগ্রাউন্ডে মুষলবর্ষণ। আমি যতবার আঁকতে বসেছি নমিতার এই দুঃখী মুখটি বার বার ভেসে উঠেছে। মহা আনন্দে আমি ধামরাই ফিরে এলাম। পালপাড়ার যত কাছাকাছি আসছি আমার বিরহযাতনা তত বেড়ে যাচ্ছে। উত্তেজনার পারদ এমনভাবে চড়ছে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ওই তো রথখোলা, রথ দাঁড়িয়ে আছে। রথ পেরিয়ে নদী। নদীর ওপর ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে ওপারে টঙের দোকান। ওই দোকানে আজও আমি চা খাবো। দোকানদার আমাকে দেখে খুব অবাক হবে। আমি এখন পালপাড়ার জামাই। আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। দোকান থেকে নমিতাদের দোতলা বাড়ি দেখা যায়। আমার আসার খবর নমিতাকে আগে জানাতে পারলে ভালো হতো। ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকত। আমাকে দেখামাত্র দৌড়ে আসত, উড়ে আসত। আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত।ব্রিজ পাড় হয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। টঙের দোকানটা নিই। সেখানে পাকা একতলা দালান। বড় একটি মনিহারি দোকান। দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে একটি টঙের দোকান ছিল?’
লোকটা বলল, ‘পাঁচ বছর ধরে দোকান করছি।’
এখানে কোনো টঙের দোকান দেখি নাই। আমি দ্বিধায় পড়ি। কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে? পালপাড়াটা কোনদিকে? একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে প্রথম যে রাস্তাগেছে, ওটা ধরে এগিয়ে গেলে পালপাড়া পাবেন।আমার মনে আছে ডান দিকে গিয়েছিলাম।দোকান থেকে বেরিয়ে আমি ডানে-বামে তাকাতে লাগলাম। ডানদিকে একটি মাত্র দোতলা। ওইতো ওই বাড়ি। নারিকেল গাছগুলো হাওয়ার দুলছে। আমার ভেতর উত্তেজনা টগবগ করে উঠে। আমার ডাকাডাকিতে একজন তরুণ বেরিয়ে এলো। হাসিমুখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন?’
তরুণটি ভ্রূ কুঁচকে সন্দেহের চোখে আমাকে দেখল, ‘আপনে কে?’
‘আমি? আমাকে চিনতে পারছেন না!’ আমি বিগলিত হয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে পড়লাম।
শুনেছি নমিতার ভাইরা রাগী। সন্দেহ মুক্ত হওয়ার
জন্য আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা নমিতাদের বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, নমিতাদের বাড়ি।’
আপনারা তিন ভাই। নমিতা আপনাদের একমাত্র বোন।
‘ঠিক আছে।’
‘নমিতাকে ডাকেন। সে আমাকে চিনতে পারবে।’
তরুণটি বাড়ির ভেতর গেল নমিতাকে ডাকতে।
ফিরে এলো তিন ভাই। ছোট ভাই বলল, ‘দাদা, লোকটা বদ মতলব নিয়ে এসেছে। একটু শিক্ষা দিয়ে দিই।’
বড় ভাই ছোটকে থামিয়ে বলল, ‘কারে চান?’
তিন ভাইয়ের শরীর স্বাস্থ্য দেখে সভয়ে বললাম,
‘নমিতার সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে আমাকে চেনে।’
‘নমিতা আছে ওর শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর-সংসার করছে। আপনার কোনো ভুল হইছে।’
আমি বিভ্রান্ত বোধ করি। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের কাছে নিজেকে অচেনা মনে হয়।
‘এটা পালপাড়া না?’
পালপাড়া বড় রাস্তার বাঁ দিকে। পালপাড়ায় নমিতাকে খুঁজে পেলাম না।তাজমহল খুঁজে হয়রান হলাম। শাহজাহানের
আস্তানা খুঁজলাম। মাজার খুঁজলাম। সারাদিন
খুঁজে ফিরলাম। কেউ চেনে না। কেউ বলতে পারে
না। আমি কোথায় পাব তাকে? আমার মমতাজ
আমার তাজমহল? একজন বলল, ‘তাজমহল
খুঁজছেন, শাহজাহানকে চান? আগ্রায় যান।’
কয়েকজন আড্ডাবাজ ছেলে বলল, ‘কছিলিম
টানছেন? ধামরাই এসেছেন তাজমহল খুঁজতে!’
তিন মাস আমি ধামরাই কাটালাম। কোথায় ভুল হয়েছে আমি খুঁজে বেড়াই। যা কিছু ঘটেছে
তাকি শুধু স্বপ্ন! আলো ছায়ার কল্পকাহিনি? নাকি অচেতন জাগরণের মাঝে কোনো ধ্রুব সত্য, যা আমি বিস্মৃত হয়েছি? নাকি এ আমার এক জীবনের ভেতর আরেক জীবন?
ভিন্ন এক জীবন। সে জীবনে নমিতা ছিল। সে জীবন আমি বিস্মৃত ছিলাম। এক ঘনঘোর বর্ষায় আমার বর্তমান জীবনের মাঝে জেগে উঠেছে আমার ভিন্ন জীবন। স্মৃতির সুবাস দিয়ে আবার সে অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। তাঁকে আমি খুঁজে ফিরছি। কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষেরে?
আমার আঙুলে নমিতার দেয়া আংটি যখন দেখি মনে হয় আমি সঠিক পথে আছি। নমিতা আছে। নমিতা কোনো কল্পকাহিনির গল্প নয়।স্মৃতি ফিরে পেলে নমিতাকে ফিরে পাবো কিংবা নমিতাকে পেলে আমার স্মৃতি ফিরে আসবে।
আমার আর ঢাকায় ফেরা হয়নি। ছবি আঁকা ভুলে গেছি। বাংলাদেশের নানা জায়গায় আমি নমিতাকে খুঁজে ফিরেছি। দশ বছরে বাংলাদেশের তিরিশটি জেলার সকল পাল পাড়ার নমিতাকে খুঁজেছি। তেষট্টি জন নমিতা পালের দেখা পেয়েছি। তারা কেউ আমার নমিতা নয়।চুল দাড়ি গোঁফে আমাকে এখন
সাধুসন্তের মতো দেখায়। ধামরাইয়ের পালপাড়ার নমিতাকে আমি কুমিল্লার এক গ্রামে খুঁজে পেয়েছি। আমাকে দেখে বলল, ‘আপনার কথা আমি শুনেছি। দাদারা বলেছে, একটা পাগল নমিতার খোঁজে তোর কাছে আসতে পারে।’ নমিতা আমাকে প্রণাম করল। তিন ছেলেমেয়েকে আমার
কাছে ডেকে আনলো। থালায় করে মিষ্টি খেতে দিল। আঁচলে চোখের জল মুছে বলল, ‘বাবা, আমার মন বলছে আপনার নমিতাকে ফিরে পাবেন।’