Thursday, February 13, 2025
spot_img
Homeমন জানালামনের উঠান : ক্যামেরা

মনের উঠান : ক্যামেরা

ওয়াহিদুল হুদা ডালটন

খুব ছোটবেলা থেকেই চৌকোনাকৃতি আলোকচিত্র ধারণ বাক্স বা ক্যামেরার প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। এর পেছনের মূল কারণ ছিলেন ফিকশন ইসলাম, আমার ছোট মামা, যিনি আমার জীবনের বিচিত্র শখ আর গতিপ্রকৃতির বেশিরভাগেরই প্রভাবক। আমার বই পড়া, ফটোগ্রাফি, গান, লেখালেখি, ঘোরাঘুরি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি বানানোসহ আরও বিবিধ বিচিত্র শখের জন্ম অনেকটা এই ভদ্রলোকের কারণেই।

আমার ওপর ছোট মামার প্রভাব যে ব্যপক, তা আমি নিজেও স্বীকার করি। যাক, সেসব গল্প অন্য কোনোদিন হবে। যা বলছিলাম। আমার ছোট মামা পড়তেন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান রুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। পড়ালেখার পাশাপাশি দৈনিক বার্তায় ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। আমাদের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করতেন তিনি। তখন থেকেই তাঁর বাইসাইকেলে চড়ে নানা জায়গায় ঘুরতাম। তাঁর কাজ দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম, আমিও একদিন ছবি তুলে বেড়াব ছোট মামার মতোন।

এভাবেই আমার ভেতরে জন্ম নেয় এক ফটোগ্রাফারের, যাকে সবাই হালে খুব স্টাইল করে ছবিয়াল বলেন (আমার কাছে তার চেয়ে আলোকচিত্রী বা ফটোগ্রাফার শব্দগুলোই বেশি পছন্দের, ওসব গাড়িয়াল মার্কা টার্ম ভালো লাগে না কেন যেন)। প্রথম ক্যামেরা হাতে আসে খুব সম্ভবত ছয় বা সাত বছর বয়সে। একটা নষ্ট ক্যামেরা ছোট মামা দিয়েছিলেন খেলতে। মজার বিষয়, কোনো শাটার ছিল না ক্যামেরাটার মাথার ওপর। তার বদলে লেন্সের পেটের কাছে ছিল একটা লিভার। ওটা টেনে ধরে ছেড়ে দিলেই ছবি তোলা হতো। মানে ওই লিভারটাই ছিল শাটার। বুঝতেই পারছেন, শাটার স্পিড থাকত একদম নিজের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং কত সময় ধরে আলো ফিল্মে ফেলতে হবে, তা একদম নিজেকে বুঝে নিতে হতো (যেটা বর্তমান ক্যামেরায় ম্যানুয়াল মোডে থাকে)।

ওটার জন্য যে ফিল্ম ব্যবহার করা হতো, সেগুলো যদ্দূর মনে পড়ে অনেকটা কার্বন পেপারের মতোন। সেই বয়সে সেই নষ্ট ক্যামেরা নিয়েই কী উল্লাস আমার! ওটা নাড়াচাড়া করতে করতেই শিখে যাই ক্যামেরা খোলা, রিল লাগানো থেকে শুরু করে শাটার, এপারচার ইত্যাদি কীভাবে কাজ করে। যন্ত্রপাতির প্রতি ঝোঁক ছোট থেকেই। কোন যন্ত্র কী করে কাজ করে, তা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে চাইতাম। বাসার টুলবক্স ছিল আমার হেফাজতে। খেলতে খেলতে পুরো ক্যামেরা ভেঙে এর কারসাজি আবিষ্কার করি তখন। ধীরে ধীরে ছোট মামা বুঝতে পারেন, এই যন্ত্রটার প্রতি আমার আগ্রহ আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তিনি অবশ্য এতে খুশি। নিজের শিষ্য কে না চায়? এবার তিনি তাঁর ব্যবহার করা ক্যামেরা ধরতে দিতে লাগলেন আমাকে। শেখাতে লাগলেন টুকটাক ফটোগ্রাফির কায়দাকানুন। ক্লিক ক্লিক ক্লিক… শুরু হলো আমার সত্যিকারের ছবি তোলা। তখন মনে হয় ৯ বা ১০ বছর বয়স আমার। তবে তা কদাচিৎ সুযোগ হতো কারণ, ফিল্ম ক্যামেরায় একেকটা ফিল্ম ছিল মহামূল্যবান বস্তু। এ তো আর হালের ডিজিটাল ক্যামেরা বা স্মার্টফোন নয় যে মনমতো ছবি তোলো, মেমোরি কার্ড বোঝাই করো আর দরকার হলে মুছে ফেলো। এখন তো বাচ্চা জন্মে খেলনার আগে ফোন হাতে ধরে (মোবাইল ফোনের উজ্জ্বল রঙিন পর্দায় চোখ ধাঁধিয়ে যার শুরু হয় পৃথিবী চেনার প্রথম পাঠ, সে কি সাদামাটা কাগজে আকৃষ্ট হয়?)।

এই প্রজন্মের কাছে ক্যামেরা, ছবি এসব যত সহজ, তখন সেটা ছিল না। সাদাকালো ফিল্ম রোলের দাম ছিল ২৫-২৮ টাকা আর ফুজি রঙিন ফিল্ম ছিল ১১০-১৩০ টাকা। আইএসও বা আলোক স্পর্শকাতরতার ওপরে নির্ধারিত হতো ফিল্মের দাম। একেকটা রিলে থাকত ৩৩/৩৫টা ফিল্ম। এর পর আছে নেগেটিভ ফিল্ম ডেভেলপ করা, ছবি প্রিন্ট করা। সে বেশ খরচের ব্যপার, সুতরাং সেই সময় মধ্যবিত্ত ঘরের একজন ছাত্রের কাছে প্রতিটি ফিল্ম ছিল অনেক দামি। আসলে ফটোগ্রাফি বিষয়টাই ছিল মধ্যবিত্তের ঘরে খুব সীমাবদ্ধ শখ।

সেই সময় শুরু হয় আমার ছবি তোলার শিক্ষা গ্রহণ। মামা আমাকে ফ্রেম বোঝাতেন, আইএসও, শাটার স্পিড, এপারচার রিলেশন বোঝাতেন। আমি সেসব শিখে টুকটাক প্রয়োগ করে অপেক্ষা করতাম কবে রিল ফুরাবে, মামা ডেভেলপ সেরে প্রিন্ট করিয়ে আনবেন আর আমি দেখব কেমন ছবি তুললাম। সে ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। মধুর অপেক্ষা।

এভাবে দিন যায়। বছর গড়ায়। আমার মনে বাসা বাঁধা স্বপ্ন পূরণের জন্য এবার আমি শুরু করি অল্প অল্প করে পয়সা জমাতে। মা ব্যাংকার ছিলেন। ছোটবেলাতেই তাই আমার আর আমার বড় দুই বোনের নামে আলাদা আলাদা সঞ্চয়ী হিসাব খুলে দেন অগ্রণী ব্যাংকে। সেখানে আমরা টাকা জমাতাম। আর ছিল আমার মাটির ব্যাংক। যখন যা পেতাম, চেষ্টা করতাম জমাতে। ছোট মামাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, কোন ক্যামেরার দাম কত আর মনে মনে হিসাব করতাম আর কত টাকা জমাতে হবে। স্কুলের হাতখরচ, ঈদের পরবি (ঈদি বলে যাকে) এসব থেকে নিজের অন্যান্য শখ যেমন মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, লাটিম বা ছিপ-বড়শি কেনার পাশাপাশি চলত বড় প্রকল্পের জন্য সঞ্চয়। ততদিনে অষ্টম শ্রেণিতে উঠে গেছি। ছোট মামা কী একটা কাজে ঢাকায় যাবেন। এদিকে আমার যথেষ্ট টাকা জমানো হয়ে গেছে। আম্মাকে বললাম যে আমি ক্যামেরা কিনব। না বললেই নয়, আমার গান, ছবি তোলা, বই পড়া বা লেখালেখি এসবে মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল প্রচুর। তিনি হাতে ধরে আবৃত্তি শেখাতেন। আর পুকুরময় দাপিয়ে বেড়ানো, ঘুড়ি-লাটাই, লাটিম বা ছিপ-বড়শির আশকারা দিতেন আব্বা।

মা ছোট মামাকে ডেকে আমার জমানো ১৩০০ টাকা (কী হাসি পাচ্ছে পরিমাণ শুনে? সেটা তখন বিশাল অঙ্ক কিন্তু!) মামার হাতে দিলেন। মামা ঢাকায় গেলেন। কবে ফিরবেন, জানি না। সেলফোন তো দূরে থাক, টিঅ্যান্ডটির ফোনও তখন বিরল জিনিস। কাজেই যোগাযোগ করে জানার উপায় নেই কী হচ্ছে। অপেক্ষায় আছি তো আছিই।

তারপর একদিন সকালের ঘটনা। ঘুম ভেঙে দেখি আমার পাশে বিছানায় কয়েকটা বক্স। চিনতে একমুহূর্ত দেরি হয়নি। একটা বক্সে ক্যাননের একটা ফিক্সড লেন্স ম্যানুয়াল ক্যামেরা, একটাতে ফ্ল্যাশ আর একটা সাদাকালো ফিল্ম রোল। মনে হলো দীর্ঘ স্বপ্ন দেখা রাতের ভোর হলো তা পূরণের মাধ্যমে। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে এসে দেখি আম্মা, আব্বা আর ছোট মামা ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করছেন। মামা ভোরের ট্রেনে এসেছেন। আমাকে দেখে মামা হাসি হাসি মুখে অথচ ধমক দিয়ে বললেন, ‘নে তোর ক্যামেরা, খুশি তো?’ ছোট মামা সবার সঙ্গেই একটু ধমকের সুরে কথা বলেন। সবাই তাই মামাকে বেশ ভয় পায়। আমিও পেতাম, কিন্তু ঠিকই বুঝতাম ধমক হলো এই মানুষটার ভালোবাসার প্রকাশ। আমার সেই সময়ের মনের অবস্থা বলে বোঝানো কঠিন। শুধু এটুকুই বলতে পারি, লিখতে বসে এখনো আবেগে চোখ ভিজে গেছে আমার। চোখ মুছতে মুছতেই লিখছি। ছোট মামার দিকে বাড়িয়ে দিলাম ক্যামেরাসহ সব। মামা আস্তে আস্তে ক্যামেরাটা প্যাকেট থেকে বের করলেন। তাতে ব্যাটারি দিলেন। ফিল্ম লাগালেন। আমি দুনিয়ার সব আগ্রহ, ভালো লাগা এক জায়গায় জড়ো করে সেই কাজ দেখতে থাকলাম। মনে হলো অনন্তকাল ধরে মামা কাজটি করছেন। ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে মামা বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে। আমার তখন হাত কাঁপছে। সেই ছোটবেলা থেকে যেই যন্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত, আজ মনে হচ্ছে সেটা নতুন করে চিনছি। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ক্যামেরাটা হাতে নিলাম।

মনে হলো স্বপ্ন আমার হাতের মুঠোয়। একদম নিজের টাকায় কেনা স্বপ্ন। কারো ভাগ নেই তাতে। না না ভাগ আছে। সেই দারুণ সময়ের সাক্ষী হিসেবে আব্বা, আম্মা আর মামাও ভাগিদার হলেন সেই স্বপ্নের। সবার মুখে হাসি। ছোট মামাকে বললাম, আমি না, আপনিই প্রথম ছবি তুলে দেন। এরপর আমার নিজের প্রথম ক্যামেরার প্রথম মডেল হলাম আমি নিজেই। বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম একটা গোলাপ গাছের পাশে। ছোট মামা তুললেন আমার ছবি। আমার মনে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। জীবনের প্রথম ক্যামেরার মালিক হওয়ার ইতিহাস। আজ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট অর্থ দিয়েছেন।

মন চাইলেই অনেক কিছু কিনে ফেলতে পারি, কিনিও। কিন্তু সেই প্রথম নিজের পয়সায় ক্যামেরা কেনার অনাবিল আনন্দের কাছে সেইসব নস্যি। সে মুহূর্তের ছবিটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আজ শেয়ার করলাম।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments