২য় পর্বের পর..
অধ্যাপক শরিফা রাজিয়া
পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা দিনের পর দিন কীভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণ করেছে বঙ্গবন্ধুর দিনলিপিতে উঠে এসেছে তার বর্ণনা। তিনি লিখেন, ‘৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায় ? বাঙালিদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কিছুই নাই। ১৯ বৎসর পর্যন্ত চলেছে শোষণ আর লুণ্ঠন।’ (১৪ই জুন ১৯৬৬।। মঙ্গলবার, পৃ.-৮৮,৮৯ কারাগারের রোজনামচা।)
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশদের চেয়েও ভয়াবহভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে বাংলাকে শোষণ করেছিল তার চেয়েও উলঙ্গভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছে।’ (১৪ই জুন ১৯৬৬।। মঙ্গলবার, পৃ.-৮৯ কারাগারের রোজনামচা।)
কনসর্টিয়াম ১৯৬৬-৬৭, সালে পাকিস্তানকে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেখানেও যে পূর্ব পাকিস্তানকেই বেশি খেসারত দিতে হবে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত হলেন। তিনি লিখেছেন, ‘মনে রাখা দরকার, এই ডলার সবই ঋণ নেওয়া হলো। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কপালে কি আছে আমরা জানি না, তবে সুদ সহ টাকা পূর্ব পাকিস্তানকেই বেশি ফেরত দিতে হবে।’ (১০ই জুলাই ১৯৬৬।। রবিবার, পৃ.-১৫৬ কারাগারের রোজনামচা।)
১৯৬৬-৬৭ সালে যে নয়া আমদানী নীতি হলো সেখানেও একচেটিয়া পুঁজিবাদী সৃষ্টি করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র আমদানীকারকরা নিঃশেষ হবে। যার মধ্যে পূর্ব বাংলায় ক্ষুদ্র শিল্পপতিরা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৯৬৬-৬৭ সালে নয়া আমদানী নীতি পরলাম, বোঝা গেল প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র আমদানীকারকগণ টিকে থাকতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানিরা যাও দুই একজন কিছু কিছু আমদানি করত, তারাও শেষ হয়ে যেতে বাধ্য হবে।’(১৬ই জুলাই ১৯৬৬।। শনিবার, পৃ.-১৬৪ কারাগারের রোজনামচা।)
সেই সময় যেসব পত্রিকা পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি পাক সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণসহ ৬ দফাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনরত জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ করেছে, সেই পত্রিকাগুলোকে বাজেয়াপ্ত করা হলো। পত্রিকা মালিকরা হলেন গ্রেফতার। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে ‘ইত্তেফাক’ ইংরেজি ‘সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস’ ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’ প্রকাশিত হইত। পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পূর্বের দিন ইত্তেফাক ও নিউনেশন প্রেসের মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছে।” (১৮ই জুন ১৯৬৬।। শনিবার, পৃ.-১০২, কারাগারের রোজনামচা।)
পূর্ব বাংলার মানুষ পাক সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণসহ জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৭, ১৮, ১৯ তারিখ জুলুম প্রতিরোধ দিবস কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এই কর্মসূচিকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে পাক সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু লিখেন, ‘পূর্ব বাংলার প্রায় সমস্ত জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেওয়া হবে না। নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার উপর গুলি করে, প্রেস বন্ধ করে দিয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা দিয়ে কিছু দিনের জন্য আন্দোলন বন্ধ রাখা যায়। বেশী দিন না।’(১৯শে জুন ১৯৬৬।। শনিবার, পৃ.-১০৮, কারাগারের রোজনামচা)
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসম্ভব সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ের মানুষ। নিজের স্বার্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জনগণের স্বার্থেই তিনি রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১১টি মামলা দায়ের করেছে আইয়ুব মোনায়েম সরকার, ১৯৬৫ সালে ২০ শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে মামলা হয়েছিল।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে কারাগারের ‘রোজচামচা’ বইটি একটি অসাধারণ সৃষ্টি। সৃজনে মননে সৃষ্টিশীলতায় অনন্য বইখানি উত্তাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের প্রকৃত ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। এর প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি শব্দে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামশীল জীবনের কথা, যা আমাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে, আমাদের বোধকে শাণিত করে। বইখানি বাঙালি জাতির তথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে অন্তহীন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
১. কারাগারের রোজনামচা – শেখ মুজিবুর রহমান
২. শেখ মুজিব আমার পিতা – শেখ হাসিনা