– আহমেদ আল আমীন
কী শরিফ! আজও গাড়িতে যাবা না?
না মবিন ভাই। আপনি নেমে পড়েন। সাড়ে ১১টা বাজে।
শরিফের চোখ কম্পিউটারের স্ক্রিনে। আর হাতের আঙুলগুলো খেলছে কি-বোর্ডে। নিউজরুমে থাকা তিন-চারজনের সবাই নেমে গেছে নিচে। রাত সাড়ে ১১টা বাজে। ১১টা ৪৫-এ অফিসের গাড়ি ছাড়বে। পৌঁছে দিয়ে আসবে বাড়ি বাড়ি।
মবিন বয়সে বড় শরিফের চেয়ে, কিন্তু পদে নয়। মবিনের দিকে না তাকিয়েই শরিফ বলে, মবিন ভাই আপনি যান। আমি নিউজটা করে নামি। এই নিউজ সকালে রাখার জন্য না।
মবিন আবার বলে, ‘তুমি নিয়াজকে বুঝিয়ে দিয়ে যাও। ওর তো নাইট ডিউটি। সারারাত তো সে ঘুমাবে। দেখ এখন পর্যন্ত আসে নাই। সাড়ে ১১টা থেকে ওর ডিউটি শুরু হওয়ার কথা, কেয়ারলেস।’
শরিফ হাসে। ‘মবিন ভাই আপনি নামেন তো। দেখা যাবে আপনিও গাড়ি মিস করেছেন। মোহাম্মদপুর যাবেন, অনেক দূর। বাসটাস এখন কিছুই পাবেন না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি সাবধানে যেও।’
শরিফ চায়ে চুমুক দেয়। আবার হাত চালায় কি-বোর্ডে। একটু ভাবে, আবার লেখে। গাজীপুর থেকে আসা একটা নিউজ। স্থানীয় সংবাদদাতা পাঠিয়েছে। খুবই দায়সারাভাবে লেখা। একটা আট বছরের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধু তাই না, ধর্ষণের পর মেয়েটাকে চাদরে পেঁচিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। একেবারে পল্লি গ্রামের মেয়ে। মেয়েটার বাবা নেই। ওর মা আর ও, এই ছিল সংসার। দেড়শ শব্দ লিখে থানার ওসির একটা বক্তব্য দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিউজটা পাঠায় গাজীপুরের প্রতিনিধি। নিউজটা হাতে পেয়ে গাজীপুর প্রতিনিধিকে ফোন দেয় শরিফ।
‘আমজাদ ভাই। আছেন ভালো। কী ব্যাপার বলেন তো, ছোট্ট একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরেও ফেলল…।’
‘হ ভাই। রাত ৯টার দিকে খবর পাই। থানায় ফোন দিই। ভাই, ওসি সাবের বক্তব্য আছে তো। আর কোনো সমস্যা নিউজে?’
‘মামলা হয়েছে?’
‘মামলা করতে গেছিল ওর মা। গরিব মানুষ তো এরা। বুঝেটুঝে না। ওসি বলসে, সকালে আইসো, দেখব?’
‘আর লাশ?’
‘দিয়া দিসে ওর মায়েরে।’
‘ওমা পোস্টমর্টেম?’
‘শরিফ ভাই, এরা গরিব মানুষ। এত কিছু বুঝে? আর মাইয়া তো মইরাই গেছে। মায়ে আর পাইব। লাশ দিয়া দিসে। এতক্ষণে জানাজা হয়ে বোধ হয় কবর হয়ে গেছে।’
‘আমজাদ ভাই, আমি অফিসে আছি আরও কিছুক্ষণ। আপনি আরও একটু খবর নেন না প্লিজ। একটু আপডেট করে দেব। এটা আমার অনুরোধ।’
‘আচ্ছা ভাই, আমি দেখছি। আপনারে ফোন দিচ্ছি।’
রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিউজটা শেষ হলো শরিফের। নিউজটার হেডলাইন দাঁড়াল এমন—
‘ধর্ষণের পর হত্যা, নিথর শিশুর দাম ২ হাজার টাকা’
মেয়েকে দাফন করে সারা রাত কান্নাকাটি করছিলেন সুফিয়া বেগম। একদল লোক এসে বলল তাঁকে, ‘থানায় আর যাইও না। ধরো, এ টাকাটা রাখো।’ সুফিয়ার হাতে গুঁজে দেওয়া হলো টাকা। লোকজন চলে যাওয়ার পর সুফিয়া হাতের মুঠোয় দেখে এক হাজার টাকার দুইটা নোট।
রাস্তায় নামতে নামতে পৌনে ১টা বেজে গেল শরিফের। এতে সে অভ্যস্ত। নিউজ রেখে গাড়ি ধরার জন্য সে উঠতে পারে না। তাঁর কাছে সাংবাদিকতাটা কেবল চাকরি না। মানুষকে জানানোরও তো একটা বিষয় আছে। এই যে সুফিয়ার সঙ্গে এত বড় একটা অন্যায় হলো, এটা নিশ্চয়ই তাঁর অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে কাল সকাল নাগাদ অনেকেই জেনে যাবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানবে, সরকার জানবে। সুফিয়া মেয়ে হারিয়েছে, ন্যায়বিচার তাঁর প্রাপ্য।
এরই মধ্যে সিগারেট ধরিয়েছে শরিফ। এতসব ভাবতে ভাবতে হাতিরঝিলের এক প্রান্তে চলে এসেছে সে। এই সময়টা রিকশা দু-একটা থাকে। তবে হাতিরঝিলের কাছেই শরিফের বাসা। রিকশা না নিয়ে হেঁটেই রওনা দেয় বেশিরভাগ সময়। অন্ধকার, পুলিশ, ছিনতাইকারী কোনো কিছুতেই ভয় নেই শরিফের। পকেটে অফিসের আইডি কার্ড আছে। আর এত আসা-যাওয়া এই পথে সবাই চেনে তাঁকে।
হাতিরঝিলের এক পাশে এই সময়ে বারবণিতাদের আনাগোনা শুরু হয়। কড়া সাজুগুজু করে নানা বয়সী মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে নানা শ্রেণির লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে তাঁদের সঙ্গে। কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কেউ বা পাশের ঝোপেই। আবার গুলশান-বনানীর বড় গাড়িওয়ালা লোকজনও আসে। গাড়িতে করে নিয়ে যায়।
শরিফের প্রায়ই ইচ্ছা হয় ওই ভিড়টাতে গিয়ে দাঁড়াতে।
একবার এক ঘটনা ঘটেছিল।
সে রাতে হেঁটে যাওয়ার সময় শরিফ দেখে, তার পকেটে সিগারেট নেই। এক সিগারেটওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে ওই মেয়েদের মাঝখানে। মেয়েরা, খদ্দেররা পান-সিগারেট কিনছে। শরিফ সিগারেটওয়ালার দিকে আনমনে তাকিয়ে হাঁটছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সে কি সিগারেট কিনবে নাকি চলে যাবে? বাসায় গেলে সকাল ১০টার আগে নামা হবে না।
ঠিক এমন সময় মেয়েদের ভেতর থেকে একজন ডাক দেয় শরিফকে।
‘স্যার, আসেন। আপনার সিগারেট লাগবে?’
শরিফ হতভম্ব হয়ে যায়। হঠাৎ ডাকে সে নার্ভাস হয়ে যায়।
‘ওই জামাল, যা স্যারকে সিগারেট দিয়ে আয়।’
শরিফ তখনো আনমনা। হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার দিল, ‘স্যার দাঁড়ান। আসবেন না।’
অভিনব এক ঘটনা ঘটল, যার জন্য শরিফ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। একটা ট্রাক যাচ্ছিল বেশ দ্রুত। শরিফ সেটা খেয়াল করেনি। মেয়েটা চিৎকার না দিলে শরিফ ট্রাকের নিচেই পড়ত।
‘স্যার, আসেন এবার। জামাল, স্যারকে সিগারেট দে।’
শরিফ মেয়েটির দিকে একবারও তাকায়নি। গোটা পাঁচেক মেয়ে আর তিন-চারজন খদ্দের নিয়ে এখনো ছোটখাটো একটা ভিড়। ঠিক মাথার ওপরে কোনো স্ট্রিট লাইট নেই। কাছের স্ট্রিট লাইটের আলোর সবটা এখানে আসে না। কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে একটু ম্লান। সিগারেট ধরাতে গিয়ে মেয়েটিকে দেখল শরিফ। উজ্জ্বল শ্যামলা। খুব কড়া সাজুগুজু নেই। বেশ টেনে কাজল দেয়া চোখে।
এ সময় অন্য মেয়েরা শরিফকে বিব্রত করতে থাকে। ‘স্যার চলেন আমারে নিয়া। বাসায় যাইবেন নাকি অন্য কোথাও।’
শরিফ এখন পালাতে পারলে বাঁচে। শরিফকে উদ্ধার করল ওই মেয়েটিই। আর তাতে শরিফ আরও অবাক হলো। ‘ওই তোরা সব সর। স্যার ভালো মানুষ। সাংবাদিক। এখান দিয়া সব সময় হাঁইটা যায়, তোরা দেখস না? স্যারের বউ আছে। মাশাল্লাহ ছোট্ট একটা মাইয়া আছে। স্যার, আপনি যান। ওরা বুঝে নাই। মাফ করে দিয়েন।’
সিগারেটওয়ালাকে দ্রুত টাকা দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে শরিফ। আকাশপাতাল এক করে ভাবতে থাকে, মেয়েটি তার সম্পর্কে জানল কী করে? এমনকি তার বউ আছে, মেয়ে আছে এসব তথ্য জানে, সাংবাদিকতা করে এটা জানে, অদ্ভুত!
রাতদুপুরে শরিফ বাসায় ফেরে। তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে। ততক্ষণে মীরা আর অবন্তী ঘুমের দেশে। মীরা তার স্ত্রীর নাম। আর অবন্তী তার মেয়ে। অবন্তীর বয়স সাত বছর।
করোনার কালে
‘শরিফ এখন তো আমার সত্যিই ভয় লাগছে ভাই। এত দিন বিষয়টা আমলে নেই নাই। এখন দেখি ঢাকায় ধরা পড়ছে করোনাভাইরাস।’ মবিন বেশ চিন্তিত। মুখে মাস্ত পরে আছেন। হাতে পাতলা গ্লাভস। তুলনামূলক বয়স্ক আর অ্যাজমা রোগীরা খানিক ঝুঁকিপূর্ণ—এ তথ্য শোনার পর মবিন আরও দুশ্চিন্তায় আছেন। তাই সাবধানে থাকেন।
‘মবিন ভাই, এত নার্ভাস হয়েন না। সাবধানে থাকেন।’
‘তুমি মিয়া রাত করে বের হওয়া বন্ধ করো। এই সময়টায় বের হয়ে যেও তাড়াতাড়ি। এখন তো শহরে লকডাউন। চাইলে রিকশাও পাবা না।’ শরিফ নেমে যায় রাস্তায়। অফিসে আজ যে বিস্কুটটা দিয়েছে, সেটা অবন্তীর পছন্দের। শরিফ তখন খায়নি। বাসায় যাওয়ার সময় সেই বিস্কুটের প্যাকেটটা নিয়ে বের হলো।
লকডাউন, দীর্ঘ সরকারি ছুটি এসবের কারণে করোনাভাইরাস মোকাবিলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আয়-উপার্জন! দিনে আনে দিনে খায় মানুষেরা পড়েছে বিপদে। দুপুরে, বিকালে, রাতে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের দল। হঠাৎ দু-একটা গাড়ি আসে। কিছু বস্তা দিয়ে যায়। বস্তায় ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগে কিছু চাল, ডাল, তেল, আলু।
শরিফ এসব দেখে আর হেঁটে যায়। মানুষ একদমই নেই। গাড়ি নেই। রিকশাও নেই। স্ট্রিট লাইটগুলোর অনেকগুলোই বন্ধ করে দেওয়া। মানুষ যাতে ঘরেই থাকে, এ জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। হয়তো পথের বাতিগুলোর বেশ কয়েকটা বন্ধ করে দেওয়া এরই একটা অংশ।
শরিফ মাস্কটা পরে নেয়। চোখে চশমা আর মুখে মাস্ক। বাসায় অবন্তী আছে; কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। এই এক জিনিস হয়েছে এখন। সবাই মাস্ক পরা পথে। কেউ এসে সালাম দিলেও চেনা যায় না। মাস্ক খুলে মুখ দেখালে তবে চেনা লাগে। শরিফ ভাবে, একদিক দিয়ে ভালোই হলো, মাস্কের আড়ালে চলে যাওয়া, কেউ চিনল না।
হাতিরঝিলে ঢুকে কিছুদূর এগোতেই শরিফ দেখে দুটি মেয়ে দুজন পুরুষের কাছে হাত পাতছে। কাঁদছে। সময়টা স্বাভাবিক না। শরিফ পকেট সাবধানে চেক করে আসতে আসতে আগায়।
রিকশা, গাড়ি নেই বলে মেয়ে দুইটাকে পুরুষ দুইটা কোথাও নিতে পারছে না। ওই দুই মেয়ে আকুতি করছে এখানেই কোথাও কাজ সেরে ফেলার। দুদিন ধরে আধাপেটা হয়ে আছে তারা। কোনো খদ্দের নেই। দুদিন বাসায় ছিল। কিন্তু অভুক্ত অবস্থায় কতক্ষণ থাকা যায়?
শরিফ দ্রুত পা বাড়ায়। এ সময় মানুষের কাছাকাছিও যাওয়া যাবে না। কার ভেতরে করোনাভাইরাস ঢুকে আছে, বোঝারও কোনো উপায় নেই।
একটু হাঁটতেই আবার কথাকাটাকাটির শব্দ শুনল শরিফ। নীরব রাস্তায় শরিফ হাঁটছে। সেই হাঁটার শব্দও হচ্ছে। হঠাৎ শরিফ দেখল, ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে এক লোক। পেছনে সেই মেয়েটি। ট্রাকের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল। তবে আজ মেয়েটি খানিক বিধ্বস্ত। চোখে কাজল নেই। মুখে তাড়াহুড়ো করে করা মেকআপ আছে। তবে এই অবস্থাতেও মেয়েটিকে সুন্দর লাগছে।
লোকটি দ্রুত চলে যাচ্ছে। মেয়েটি বাধা দিল।
‘ভাই, আমার সাথে কাজটা কর। বিশ্বাস কর ভাই, আমার গা গরম হয়ে আছে। গায়ে জ্বর নাই। গা এমনিতে গরম।’
লোকটা খেঁকিয়ে ওঠে, ‘দূরে সর। এমনি গরম, তাই না? আমি জানি, করোনাভাইরাস হলে গায়ে জ্বর হয়। মাগি তোর থেইকা অসুখ নিয়া আমি বাড়িতে যাইতাম, আমার আর কাম নাই, না? আমার বাড়িতে পোলা-মাইয়া আছে।’
‘ভাই, তাইলে কয়টা টাকা দিয়া যাও। দুদিন ধরে খুব খারাপ অবস্থা। খাওন-দাওন নাই।’
লোকটা খেঁকিয়ে উঠে, ‘হ, কাম করতে পারছি না, মাগনা টাকা দিমু। ভাগ। গাভর্তি জ্বর। তোর করোনা হইসে।’
লোকটা হনহন করে চলে গেল।
শরিফ হাঁটছে। মেয়েটা শরিফকে ডাক দিল।
‘ভাই। শুনবেন।’
শরিফের মুখে মাস্ক। শরিফের মনে হলো, মেয়েটি তাঁকে চিনতে পারেনি।
মেয়েটি শরিফের সামনে এসে লাজুক হাসি হাসতে লাগল। ঠিক একসময় মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েরা যা করে সে রকম।
শরিফ নড়তে পারছে না। চৈত্রের এই গরমেও সে ঘামছে। মাস্কের ভেতরে চুলকাচ্ছে নাকটা। রাজধানীর আকাশে বিশাল চাঁদ। আর চাঁদের আলোটা পড়ছে মেয়েটার মুখে। এত সুন্দর একটা মুখ। বড় কোনো ঘরে জন্ম নিলে তার সঙ্গে কথা বলার মতো সাহস পেত না কেউ!
‘ভাই, আসেন সময় কাটাই। আপনে যা দিবেন, তাতেই চলব।’
শরিফের ধারণা আরও পোক্ত হলো, মেয়েটি তাঁকে চিনতে পারেনি।
শরিফকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি সালোয়ার খুলে ফেলল। শরিফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চাঁদের আলোটা তীব্রতা ছাড়াই দেখায় সব আর চৈত্রের বাতাসেই আছে অদ্ভুত আনন্দ। শরিফের কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি। হঠাৎ নিজেকে ফিরে পায় শরিফ। এ কি! না, না। এই মেয়েকে কাছে আসতে দেওয়া যাবে না। বাসায় মীরা আছে, অবন্তী আছে। মেয়েটি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলে?
শরিফ দ্রুত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করেনি সে। কেন যেন নিজেকে মেয়েটির কাছে চেনাতে তার ইচ্ছে হলো না। সে চাইছে না মেয়েটি তাকে চিনুক। মানিব্যাগ খুলে দেখে পকেটে ৫০ টাকা আছে। শরিফ এটাই মেয়েটির দিকে ছুড়ে দেয়।
‘ভাই। আমি কোনোদিন ভিক্ষা নেই নাই। আর আজ করছি এ রকমও কোনো দিন করি নাই। খদ্দেরের কাছে আমার দাম খারাপ না। কিন্তু করোনাভাইরাস আইসা সব শেষ করে দিল। পথে নামায়া দিল। আপনি আসেন ভাই। যা করার করেন। আমার গা গরম। বিশ্বাস করেন ভাই জ্বর না।’
শরিফ কিছু বলে না। মেয়েটির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।
মেয়েটি জামাটা পরে নেয়। তারপর বলে, ‘তাইলে এক কাজ করেন ভাই। একটু দাঁড়ান।’ বলে সে আবার ঝোপের আড়ালে গেল।
ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো একটা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি ঘুমাচ্ছিল বোধ হয়। ‘ভাই, এটা আমার মেয়ে। সাত বছর বয়স। আমারে নিয়া সন্দেহ থাকলে এর সাথে কিছু করেন। আপনারে দিয়া বনি হইব ভাই। বিশ্বাস করেন আমরা না খাইয়া মরতে চাই না।’
চোখ কপালে ওঠে শরিফের। বলে কি এই নারী। পাগল নাকি? মেয়েটির গায়ে লাল ফ্রক। চাঁদের আলোটা যেন এবার পড়ল ছোট্ট মেয়েটির দিকে। মেয়েটির বয়স সাত। শরিফের মাথা ঘোরাচ্ছে। এ রকম একটা লাল ফ্রক অবন্তীরও আছে!
শিশুটির মা তাকে বলছে, ‘যাও মা, যেমনে কইয়া দিছি, উনার সাথে এমন করবা।’
শরিফের এবার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাতে থাকা বিস্কুটের প্যাকেটটা শিশুটির দিকে ছুড়ে মারে শরিফ। এরপর দৌড় দিতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। শিশুটিও দ্রুত আসছিল তার দিকে। কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেটটা পেয়ে থমকে যায়। জোরে জোরে হাঁচি দেয় শিশুটি। তারপর বিস্কুটের প্যাকেটটি খুলে খেতে থাকে।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায় শরিফ। মাস্কটা সরে গিয়েছিল। ভালো করে পরে নেয়। কিন্তু মনে খচখচ করতে লাগল মেয়েটি তাকে চিনে ফেলেনি তো!
এদিকে শিশুর মা এসে শিশুকে মারতে লাগল। ‘খানকির মাইয়া। তুই হাঁচি দিছস কেন? হাঁচি দেওয়াতেই তো ব্যাটা চলে গেল। সে মনে করব তোরও অসুখ। তুই কাজ করলে আরও কিছু টাকা পাইতাম। এই বিস্কুট শেষ হইলে খাবি কী?’
মা-মেয়ের কাছ থেকে ততক্ষণে যথেষ্ট দূরে চলে গেছে শরিফ। ছোট্ট মেয়েটি মায়ের মারও খাচ্ছিল, বিস্কুটও খাচ্ছিল।
লেখক : সাংবাদিক