ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
পৃথিবীজুড়ে মানুষ আজ আক্রান্ত কোভিড-১৯ এ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। এ ধরনের সংকটময় জীবনে প্রবীণদের বিভিন্ন জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধির ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে।
আগে যারা নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করতেন, তারা আর সেটা করতে যান না। আগে যারা সন্ধ্যায় নিয়মমাফিক হাঁটতেন, তারাও এক প্রকার শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন অফিস-আদালত খুললেও করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুটিন নিয়মগুলো মেনে চলা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে এ সময়ে হাসপাতালের আউটডোরে যেতেও ইতস্তত বোধ করেন। চিকিৎসকের চেম্বারে যেতেও নিরাপদবোধ করেন না।
তাহলে বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে ব্যথা করলে, এই অনিশ্চিত সময়গুলোতে কীভাবে ব্যথা থেকে মুক্তি পাবেন? কীভাবে মোকাবিলা করবেন আপনার জয়েন্টের তীব্র, অসহনীয় ব্যথা? এই করোনাকালে আপনাদের জয়েন্টের সুরক্ষা দিতে কিছু পরামর্শ-
১. প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ
আপনার জয়েন্টে ব্যথা শরীরের প্রদাহ থেকে হতে পারে। প্রদাহ জয়েন্টের টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। এতে আপনার জয়েন্টগুলোর মধ্যে তরল পদার্থ সৃষ্টি হয়। জয়েন্ট ফুলে যায় এবং মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু বিষয় মেনে চলে আপনি বাড়িতে বসেই প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যেমন :
- হাঁটুতে তীব্র ব্যথা হলে, দু্ই-তিনদিন পূর্ণ বা আংশিক বিশ্রাম নিন। তবে বিছানায় শুয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন না।
- হাঁটু ফোলা কমানোর জন্য আপনি হাঁটুতে বরফের ঠাণ্ডা সেঁক নিবেন। এ ক্ষেত্রে আপনি ৫ থেকে ১৫ মিনিট আইসব্যাগ রাখতে পারেন। আইসব্যাগ না থাকলে একটি কাপড়ে বরফ মুড়ে সেটি ব্যথার স্থানে রাখুন। কিছুতেই ত্বকে সরাসরি বরফ লাগাবেন না।
২. প্রদাহবিরোধী ওষুধ ব্যবহার
করোনা মহামারির প্রথম দিকে অনেক রোগী এনএসএআইডি বা ব্যথানাশক ওষুধের কথা জেনেছেন। এসব ওষুধ সাধারণ
আরথ্রাইটিস ও জয়েন্টের ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, আরথ্রাইটিস ও জয়েন্টের ব্যথা কোভিড ইনফেকশনকে আরো খারাপ করে তোলে। তবে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে এনএসএআইডি কোভিড-১৯ কে আরো বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং এ সময়ে আপনি জয়েন্টে ব্যথার জন্য এনএসএআইডি যেমন আইবুপ্রফেন বা ন্যাপ্রোফেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে পারেন। এখন পর্যন্ত প্যারাসিটামল খুবই কার্যকর ওষুধ। সত্যিকার অর্থে কোন ওষুধটি আপনার জন্য প্রযোজ্য সেটি অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আপনার জয়েন্ট ব্যথার জন্য এবং সেই ব্যথা নিরাময়ে আপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক ওষুধ কোনটি সেটি নির্বাচনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।
৩. ব্যথা বাড়ার কারণ পরিহার
জয়েন্টে আঘাত লাগলে বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে আপনার জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যাওয়ার আরো কারণের মধ্যে রয়েছে চাপ, আবহাওয়া, বারবার হাঁটাচলা করা, ইনফেকশন ও অতিরিক্ত ওজন। এ ক্ষেত্রে ব্যথা কমানোর জন্য যা করবেন সেগুলো হলো :
- নিচু চেয়ারে বসবেন না।
- দীর্ঘসময় একটানা হাঁটবেন না।
- সিঁড়ি দিয়ে উঠা-নামা করবেন না।
- দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
- শরীর বাঁকিয়ে ফেলতে হয়, এমন ব্যায়াম করবেন না।
আর এ সময় সঠিক খাবার গ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আপনি যা খাবেন তা সরাসরি শরীরে প্রভাব ফেলে। শারীরিক কাজকর্মের মতো খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে জয়েন্টে ব্যথা হবে। আপনার শারীরিক উচ্চতা ও ভর অনুযায়ী ওজন বজায় রাখবেন।
৪. সঠিক ব্যায়াম করুন
কিছু ব্যায়াম বাড়িতে করতে পারেন। এগুলো আপনার হিপ ও হাঁটুকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। হিপ ও হাঁটুর স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশি হলো, কোয়াড্রিসেপ মাংসপেশি। এই পেশি উড়ুর সামনে থাকে। হাঁটু সামনের দিকে সোজা করুন বা পা সামনে ছড়িয়ে দিন। চেয়ারে বসে এটি করতে পারেন। চেয়ারে বসে করলে হাঁটুকে সমান সোজা রাখুন, তাহলে কোয়াড্রিসেপ পেশির ব্যায়াম হবে।
মনে রাখবেন, ভুল ব্যায়ামে হাঁটুসহ নানা স্থলে ব্যথা হতে পারে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে ব্যায়াম ও বিশ্রাম খবু জরুরি।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
বর্তমান করোনাকালে অনেক অর্থোপেডিক সার্জন টেলিমিডিসিনের মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন। আপনি সরাসরি না দেখাতে চাইলে ভিডিও কল বা ফোনে কলের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। তবে আপনার অবস্থা গুরুতর হলে বর্তমান স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অবশ্যই মাস্ক পরে চিকিৎসকের কাছে যাবেন।
- ওয়েটিং রুমে এবং রোগীসেবার স্থানগুলোতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসবেন।
- ওয়েটিং রুমে যতটা সম্ভব কম সময় কাটাবেন। চিকিৎসককে অনুরোধ করবেন খুব দ্রুত সময়ের ভেতর আপনাকে দেখে বিদায় দিতে।
- একই সময় যেন বেশি রোগীর ভিড় না হয় সেদিকে চিকিৎসকের খেয়াল রাখতে হবে। বেশি ভিড় থাকলে চেম্বারে না যাওয়াই ভালো। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসার মান একই। তাই নির্দিষ্ট চিকিৎসকের চেম্বারে ভিড় না করে অপেক্ষারত কম ভিড়ের চেম্বারে অ্যাপোয়েনমেন্ট করুন।
- রোগীর সাথে হাসপাতালে বা চেম্বারে একজনের বেশি ভিজিটর আসবেন না। রোগী ও তার অ্যাটেনডেন্সকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। চেম্বারে ঢোকার আগে তাদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে এবং সম্পূর্ণ হেলথ স্ক্রিনিং করতে হবে।
- অপারেশনের প্রয়োজন গলে রোগীকে কোভিড১৯ পরীক্ষা করে নিতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক অর্থোপেডিকস ও ট্রমা, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল