অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
সিঙ্গেল মাদার বা একা মা যে একটি আত্মপরিচয় হতে পারে, তা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসচেতনতায় আসেনি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উপাত্ত অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদে স্ত্রী আবেদন করছেন। ২০১৮ সালে ঢাকা শহরে ডিভোর্সের হার প্রতি ঘণ্টায় একটি। প্রশ্ন হলো, ডিভোর্সের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব কী কী?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ৫৪ শতাংশ একা মা বিষণ্ণতার ভেতর দিয়ে যান, ২৪ শতাংশ দুশ্চিন্তায়, ৯ শতাংশ সামাজিক ভীতিতে আর ৬ শতাংশ বেশি মাত্রায় ডিসঅর্ডারে ভোগেন।
আবার যে মা এই সমস্যায় ভুগছেন না, তাঁদের মধ্যেও দেখা গেছে ৬৮ শতাংশ কাজের চাপ, ৬৭ শতাংশ অর্থনৈতিক চাপ এবং ৩৫ শতাংশকে সামাজিক অসম্মানের বোঝা ঘাড়ে নিতে হচ্ছে। এ গবেষণায় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, ২১ দশমিক ২০ শতাংশ নারী সেপারেশন নিয়েছেন স্বামীর পরকীয়া, পুনর্বিবাহের কারণে; শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ নারীর ডিভোর্স হয়েছে এবং ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ নারীর জীবনে একাকিত্বের কারণ বৈধব্য। এই একা মায়েদের মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ গৃহবধূ, বাকি
৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ চাকরিজীবী; অর্থাৎ অর্থনৈতিক মুক্তি মাকে স্বাবলম্বী করেছে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত এবং স্বামী থেকে আলাদা থাকেন এ রকম নারীর সংখ্যা ৯ দশমিক ১ শতাংশ হলেও ২০১৮ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশে। কিন্তু করোনা অতিমারি-পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা আকাশচুম্বী হয়েছে।
একজন একা মাকে মনে রাখতে হবে, তিনি ও সন্তান—দুটো বিচ্ছিন্ন সত্তা। সন্তানকে উজাড় করে সব দিতে গিয়ে তিনি কি নিজেকে বঞ্চিত করছেন? মনে রাখতে হবে, নিজের যত্ন নেওয়া মানে স্বার্থপরতা নয়।

মনের যত্ন যেভাবে নেবেন
# শিশুদের নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া খুবই জরুরি। এতে তারা ভিন্ন পরিবেশে কীভাবে চলতে হয়, সেটা শিখতে পারবে। বেড়াতে যাওয়া মানে টাকা নষ্ট নয়।
# ধীরে ধীরে শিশুরা যখন বড় হতে থাকবে, তখন মা এম্পটি নেস্ট সিনড্রোমে ভুগতে পারেন; অর্থাৎ তখন মায়ের নিঃসঙ্গতা বাড়তে পারে। কাজেই একা মাকে আগে থেকে বুঝতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ের পরে তাঁর জীবনে শিশুরা আর থাকবে না। সেই জীবন কেমন হবে, তার পরিকল্পনা আগেই করে রাখা ভালো।
# মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনায় খাবার, শরীরচর্চা, কাউন্সেলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। একা মা জানেন, তাঁর পাশে কেউ নেই।

# মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সন্তানের ভূমিকা রয়েছে। সন্তানদের এটা শেখানো প্রয়োজন যে মায়ের যখন প্রয়োজন হবে, মমতার হাত যেন তারা বাড়ায়।
# কারো ওপর নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব না দিয়ে মায়েরা কীভাবে নিজে নিজেকে ভালো রাখতে পারেন, সে বিষয়ে ভাবতে হবে।
# প্রথম কথায় সন্তানকে সম্পত্তি লিখে দেবেন না। যত দিন প্রয়োজন, ভোগ করার পর আপনি মারা গেলে সন্তান সেগুলো এমনিতেই পাবে। নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহারের জন্য কিছু টাকা ব্যাংকে রাখুন। এ ছাড়া আলাদা করে দুটো ভাগে টাকাপয়সা রাখবেন। একটি ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য, অন্যটি বেড়ানোর জন্য।
# একা মায়ের নিরাপত্তা, সেবা, মানসিক স্বাস্থ্য, একাকিত্ব দূরীকরণ—এই সব কটির মিলিত প্যাকেজ হচ্ছে নিজেকে সেবামূলক কাজে জড়িত করা। এটা অনেকটা নিজের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। আজ আমি সমাজকে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যেদিন প্রয়োজন হবে, কেউ না কেউ সেটা আমাকে ফিরিয়ে দেবে।
লেখক : চিকিৎসক ও কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা