ডা. মো. আসাফুজ্জোহা রাজ
ঈদুল আজহার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের পর আমরা উল্লেখযোগ্য রোগী পাই, যারা মাড়ির রোগ অথবা দাঁত ভেঙে আসে। ঈদ-পরবর্তী মুখের মধ্যকার সমস্যা এবং আগে থেকেই এর প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
দুই দাঁতের ফাঁকে খাবার জমা
বয়স বাড়তে থাকলে বা অন্য কোনো কারণে দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্বাভাবিক দূরত্ব বেড়ে খাবার জমতে পারে। ঈদের সময় অতিরিক্ত মাংস চিবানোর কারণে এর আঁশ সহজেই দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বস্তি বা মৃদু ব্যথা কমাতে টুথপিক, কাঠি বা হাতের কাছে যা থাকে, সেটা দিয়েই পরিষ্কারের চেষ্টা করে অনেকে।
তবে এখান থেকে মাড়িতে প্রদাহ ও সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। দুই দাঁতের মধ্যবর্তী ফাঁকা বেড়ে যায়, ফিলিং বা ক্যাপ খুলে যেতে পারে, পেরিওডোন্টাল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এক পর্যায়ে মাড়ি ফুলে যাওয়া, রক্ত পড়া, ব্যথা, দুর্গন্ধ, দাঁত শিরশির, কামড়ে ব্যথা, নড়ে যাওয়াসহ নানা জটিলতা হয়।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মুখের যত্নে অবহেলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, ধূমপান প্রভৃতিতে টুথপিক বা কাঠি ব্যবহারে জটিলতা দ্রুত শুরু হয়। অন্যদিকে অতিরিক্ত খাবার থেকে এসব রোগের মাত্রা বেড়ে মুখের অভ্যন্তরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।
কেউ আবার টুথব্রাশ দিয়ে জোরে ব্রাশ করে খাবার বের করার চেষ্টা করে, যা থেকে দাঁত ও মাড়ি উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সাধারণ টুথব্রাশের ব্রিসল দুই দাঁতের মধ্যবর্তী জায়গা পরিষ্কার করতে পারে না। টুথব্রাশ কেবল দাঁতের ৭০ শতাংশের মতো পরিষ্কার করতে পারে।
করণীয়
দাঁতের ফাঁক পরিষ্কারের সঠিক মাধ্যম হলো বাজারজাত ডেন্টাল ফ্লস নামক বিশেষ সুতা বা ইন্টার ডেন্টাল ব্রাশ। খাবার জমার প্রবণতা থাকলে ঈদের আগেই এটা জোগাড় করে নিতে হবে। ব্যবহারবিধি না জানলে মনগড়া পদ্ধতিতে না গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অথবা ইন্টারনেটের আওতায় নিজে বা পারদর্শী কারেও সাহায্যে ইউটিউব দেখে শিখে নিতে হবে।
জীবাণুনাশক মাউথ ওয়াশ, যেমন– ১% পোভিডন আয়োডিন, ক্লোরহেক্সিডিন বা উষ্ণ পানিতে লবণ মিশিয়ে খাবারের পর কুলকুচি করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাজটি করাই ভালো।
আক্কেল দাঁতের জটিলতাও বাড়তে পারে এই সময়। এই দাঁত সম্পূর্ণ না উঠলে বা বাঁকা হয়ে উঠলে চারপাশের মাড়ির মধ্যে খাবার, বিশেষ করে মাংস ঢুকে কষ্টদায়ক প্রদাহের সৃষ্টি হতে হয়। মাংস খাওয়ার পর নরম ছোট ব্রাশ দিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার রাখতে হবে। তবে আগে থেকেই যারা মাড়ির রোগে ভুগছেন, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যদিকে দুই দাঁতের সংযোগস্থলে গর্ত বা অস্বাভাবিক ফাঁকা থাকলে সেখানেও চিকিৎসা প্রয়োজন।
দাঁত ভাঙা বা ব্যথা
দাঁতে গর্ত, বড় ফিলিং বা দুই দাঁতের সংযোগপৃষ্ঠে ফিলিং, রুট ক্যানেল শেষে ক্যাপ না করা, গঠনগত দুর্বল দাঁত, নকল দাঁত ইত্যাদিতে শক্ত হাড়ের কামড় পড়লে ভেঙে যেতে পারে। এতে সৃষ্ট অমসৃণ অংশে ঘসা লেগে জিহ্বা বা চোয়ালে ক্ষত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। অন্যদিকে ভেতরকার মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথাসহ নানা সমস্যা তৈরি হয়।
করণীয়
বড় গর্ত থাকলে অবস্থা বুঝে ফিলিং বা রুট ক্যানেল করিয়ে নিতে হবে। মাড়ির দাঁতে রুট ক্যানেল চিকিৎসা শেষে ক্যাপ বা কৃত্রিম মুকুট লাগিয়ে নেওয়া জরুরি। বড় ফিলিং, বিশেষ করে সংযোগস্থানে ফিলিং থাকলে সে দাঁত দিয়ে হাড় না খাওয়া ভালো। ঈদের সময়ে চিনির তৈরি বাহারি খাবারও ক্ষতিকর। আসল দাঁত ভেঙে গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অন্যান্য
ঈদের দিন সবাই নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায়। আর এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শর্ত সুস্থ ও সুন্দর দাঁত। দাঁতে অবাঞ্ছিত দাগ, মুখে দুর্গন্ধ বা সামনের দাঁতের মাঝে ফাঁকা থাকলে একদিনের সহজ চিকিৎসায় এগুলোর সমাধান পাওয়া সম্ভব। এই ক্ষেত্রে আস্থাভাজন ডেন্টাল চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আগেই দাঁতের সুরক্ষা নিন।
মুখ ও শরীরকে সুস্থ রাখতে পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই ঈদের সময়টায় দাঁত ভালো রাখতে অতিরিক্ত মাংস ও হাড় খাওয়া থেকে নিজেকে সংযত রাখুন।
লেখক :
মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ডেন্টাল সায়েন্স (বিএফডিএস)
প্রতিষ্ঠাতা, রাজ ডেন্টাল সেন্টার, কলাবাগান, ঢাকা