Tuesday, November 18, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যআমার দেখা ওয়াহিদুল হক

আমার দেখা ওয়াহিদুল হক

শাশ্বতী মাথিন
ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে প্রথম দেখা শিশু একাডেমীর অডিটোরিয়ামে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পরপরই রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে। তখন আমি ছায়ানটে শিশু শাখার প্রারম্ভিক ‘ক’-এর ছাত্রী। দেখলাম, বেঁটেখাটো, মাথায় টাক, খদ্দরের পাজামাপাঞ্জাবি, কাঁধে একটি ঝোলা, কালো ফ্রেমের চশমা পরা একজন সৌম্য প্রবীণ আমার দিকে তাকাচ্ছেন বার বার। তখনো চিনিনি তাকে। পরে জানলাম তিনিই সেই বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী-গবেষক, সাংবাদিক, লেখক ওয়াহিদুল হক। ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিমণ্ডলে শুনে এসেছি তাঁর নাম। মুখটাই শুধু চেনা ছিল না।

এরপর কথা হলো ছায়ানটে। বাবার মাধ্যমে পরিচিত হওয়া ওয়াহিদুল হককে ‘কাকা’ ডাকতাম। তারপর যখনই দেখা হতো মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কেমন আছিস?’ উত্তরে কদমবুসি করে বলতাম, ‘ভালো’। মিষ্টি করে আস্তে আস্তে যখন কথা বলতেন সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াসের পুরোধা, নিভৃতচারী, স্নিগ্ধ এই দেবশিশুর সামনে মাথা নুয়ে আসতো। কী চমৎকার কথা বলার ধরন, উচ্চারণ, ভঙ্গি!

কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল মনোহরিয়া গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১৬ মার্চ তাঁর জন্ম। স্কুলজীবনেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজের ছাত্র হন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মহীরুহ এ মানুষটির জ্ঞানের ব্যাপকতা ছিল সর্বময়। সংগীত, স্থাপত্য, দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র-সব বিষয়েই ছিল অগাধ জানাবোঝা। বহুমাত্রিক এই মানুষটি ছিলেন সংগীত প্রশিক্ষক, সহসী কলাম লেখক, দক্ষ সংগঠক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ওয়াহিদুল হককে একটি অনুষ্ঠানে ‘শিক্ষাগুরু’ বলে অভিহিত করলে তিনি বলেন, ‘ আমি একজন সাধারণ মানুষ, গুরু নই। সংগীতকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, হৃদয় দিয়ে, প্রেম দিয়ে শেখাতে চেষ্টা করি।’

ওয়াহিদুল হকের কর্মজীবনের শুরু পঞ্চাশের দশকে, ১৯৫৬ সালে ‘ডেইলি মনিং নিউজ’ পত্রিকায়। ষাঠের দশকের দিকে ছিলেন ‘দি ডেইলি পিপল’-এর নির্বাহী সম্পাদক। স্বাধীনতা পরবর্তী ‘ডেইলি নিউ নেশন’ এবং শেষে ‘ডেইলি স্টার’-এর জয়েন্ট এডিটর হিসেবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে তৈরি করেন উদ্দীপনামূলক সংগীতদল। সেই দল মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে দেশমাতৃকার ভালোবাসায় উদ্দীপনামূলক গান গাইত।

ছায়ানটে ওয়াহিদুল কাকার প্রথম ক্লাস পেয়েছিলাম তৃতীয় বর্ষে। শেখাচ্ছিলেন ‘কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে’। দুটো করে লাইন শেখাছিলেন, আর এর অর্থ ভাব, শুদ্ধ উচ্চারণ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। পুরো ক্লাসেই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সংগীত উপাসনার বিষয়। সংগীতের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা ও জীবনবোধে সমর্পিত করতে হয় নিজের আত্মাকে। ওয়াহিদুল হকই আমাদের প্রথম শিখিয়েছিলেন সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের সংজ্ঞা।

যখন শেখাতে, ছিলেন ক্লান্তহীন। কথার পিঠে কথা সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বোধগম্য করে তুলতেন বিষয়টি। তাঁর বলা প্রতিটি শব্দ ও বাক‌্য ছিল অর্থবহ। গুরু ছিলেন তিনি সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের। আমাদের বলেছিলেন, ছায়ানট গান শেখার স্থান শুধু নয়, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ ও চর্চা করার স্থানও। আর বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন বাঙালি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

রবীন্দ্রপ্রেমী ওয়াহিদুল হক রবীন্দ্রনাথের গানকে তপস্যা করে হয়ে উঠেছিলেন ঋষি। ব্রতচারী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রসংগীতকে সমগ্র বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে দেওয়ায়। তার অনেক বড় কীর্তির মধ্যে একটি ১৯৬১ সালে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা এবং রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের প্রচলন। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ড. সানজিদা খাতুন হলেও ওয়াহিদুল হক ছিলেন ছায়ানটের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানকে প্রসারিত করতে এবং শুদ্ধ বাঙালি বোদ্ধা তৈরি করার স্বপ্নে তিনি গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, আনন্দধ্বনী ও নালন্দার মতো প্রতিষ্ঠান।

আজ ১৬ মার্চ তাঁর জন্মদিবসে গুণী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। প্রতিটি আধুনিক মানুষের মতো নিঃসঙ্গ এই মানুষটি সারাটি জীবন নিজেকে প্রচারবিমুখ রেখে, তাঁর জ্ঞানকে প্রসারিত করেছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অন্ধ সংস্কারের উর্ধ্বে এসে সবসময় ছিলেন মানুষের কল্যাণে। ওয়াহিদুক হক চেয়েছেন বাঙালি তার নিজের হৃদয়কে সম্বৃদ্ধ করুক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, যুক্তি ও জ্ঞান দিয়ে নিজের হৃদয়কে প্রসারিত করুক।

লেখক : সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

সাতকাহন
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.