দেশের বিউটি ইন্ডাস্ট্রির এক পরিচিত নাম আফরোজা পারভীন। তিনি রেড বিউটি স্টুডিও অ্যান্ড স্যালুনের স্বত্বাধিকারী। বিউটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উজ্জ্বলার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সৌন্দর্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন ডিবিসি নিউজ ও কালারস এফএমে।
এত যার গুণ, তার পথচলাটা সহজ ছিল না। লড়তে হয়েছে অনেক, লড়ছেন এখনো। কেঁদেছেন, ভেঙে পড়েছেন, বিষণ্ণতায় ভুগেছেন। আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। হার মানেননি। কেবল একার জন্য নয়, যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন অগণিত নারীর জন্য। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে তৈরি করেছেন বিউটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘উজ্জ্বলা’। শত শত নারী এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। নারী দিবসের বিশেষ আয়োজনে নিজের জীবনের গল্প জানিয়েছেন আফরোজা পারভীন। সাক্ষাৎকারে ছিলেন শাশ্বতী মাথিন।
গল্পের চরিত্রের মতো ছিলাম
ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম। উচ্ছ্বল, চঞ্চল। গাছে উঠে যাচ্ছি, সাঁতার কাটছি অথবা কাদায় ঝাঁপাঝাঁপি করছি। একেবারে যেন সিনেমা-গল্পের কোনো চরিত্র। বাড্ডা গার্লস হাই স্কুলে পড়তাম। সেই সময়টায় যেন পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতাম। ছোটবেলা থেকেই বোল্ড ছিলাম। ইভটিজারদের মেরেছি। কোনো অন্যায় কিছু কখনোই সহ্য করতাম না।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে এলাম। কলেজ ছিল কোঅর্ডিনেট। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যত মজা করা যায়, করেছি। সাহস ছিল খুব। আবেগীও ছিলাম। কলেজে উঠে প্রেম করতে শুরু করি। প্রেমের তীব্রতা এত ছিল যে বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ১৮ বছর বয়সে হুট করে বিয়ে করে ফেলি। এরপর দুজন দুজনার মতো চার বছর লেখাপড়া চালিয়ে যাই। আমার মনে হতো, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করা প্রয়োজন। এখনো তাই মনে হয়। আসলে বাঁদরামি করতাম, তবে পড়াশোনাকেও ভীষণ উপভোগ করেছি। শিক্ষকদের পছন্দের ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার একটা গুণ ছিল।
স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে
লেখাপড়া শেষ করার পর পারিবারিকভাবে আমাদের আবার বিয়ে হয়। এত বছর যেই মানুষটার সঙ্গে থেকেছি, খুনসুটি করেছি, প্রেমে ভেসে গেছি; তার সঙ্গে সংসার করতে এসে যেন ভিন্ন এক রূপ দেখতে পেলাম। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে। প্রথম দিকে হিমশিম লাগত। বছর ঘোরার পর আমিই যেন ওই বাড়ির অভিভাবক হয়ে যাই। আমার জন্য প্রতিদিনই বাড়িতে মানুষের সমাগম লেগে থাকত। বিয়ের ১০/১২ বছর হয়ে যাচ্ছিল। সন্তান হচ্ছিল না। ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছে বলে আমরা একটু দেরি করছিলাম বিষয়টিতে। সবাই আমাকে বন্ধ্যা বলা শুরু করল। নারী হিসেবে ভীষণ আত্মসম্মানে লাগত তখন।
এরপর আমি একটু জোর করে সন্তান নিই। দৈহিক কিছু জটিলতা ছিল। সেসবের সমাধান করার পর কনসিভ করি। সেটা ছিল একটি মিরাকাল চাইল্ড। সবাই খুব খুশি। আমার স্বামীও খুশি। তবে গর্ভধারণের আট মাস পর বুঝতে পারি, অন্য একটা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি। আমার স্বামী খুব সহজভাবে সন্তান ধারণের বিষয়টি নিতে পারেনি, সেটা দেখতে পাই। কারণ, সে তখন একটা পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়, আমারই অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে। স্বামীকে ফেরেশতার মতো ভাবতাম। কারণ, ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি একসঙ্গে। একটা মানুষের সঙ্গে ১০/১২ বছর সংসার করছি। তার সঙ্গেই তো আমার বেড়ে ওঠা। কিন্তু তার ভেতরে কী চলছিল, বুঝিনি। বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারি সন্তান হওয়ার ১২ দিনের মাথায়। চার দিনের মাথায় বিষয়টি ধারণা করি। সন্তান হওয়ার পর আমাকে হাসপাতাল থেকে নিতে আসার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ ছিল না। ইউনাইটেডের সামনে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িতে কোনো লোক নেই। আমি একা। আমার ছোট ভাই আসে। ছোট ভাই, সন্তান নিয়ে বাসায় যাই। বেহায়ার মতো। এখন মনে হয়, বেহায়ার মতো গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, আমি তো আমার বাড়িতে যাচ্ছি। মায়া, ভালোবাসার জায়গাটা খুব শক্ত ছিল। ৩০ মিনিট স্বামীকে না দেখলেই মনে হয় পাগল হয়ে যেতাম। ওকে না দেখতে পেলে অসুস্থ লাগত। ১২/১৪ বছরেও সেটা কমেনি। আগের মতো ছিল। কিন্তু সেই মানুষটা বদলে গেছে। এরপর ছয় মাস কোনো রকম সংসার টেকে। সে আবার একটা পরকীয়ায় জড়ায়। তখন বুঝলাম, আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে ক্ষয় করে ফেলছি। সেই সময় সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। এত কিছুর পরও কেবল সন্তানের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্সটা দিতে চাইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকল না। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেল।
প্রতিষ্ঠানের মালিক মেয়ে, সমাজ এখনো সেটা নিতে পারে না
আমার প্রথম ব্যবসা রেড বিউটি স্যালুন। রেড নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরেকটা বড় ধাক্কা খাই সমাজের কাছে। পার্লার-ভাড়া দেব না। মালিক মেয়ে ভাড়া দেওয়া যাবে না। ব্যাপারটা এ রকম যে একটা মেয়ে বুঝি এর যোগ্য নয়। সে ঠিকমতো বাড়ি ভাড়া দিতে পারবে না। ওই ধাক্কাটাও আমাকে বেশ নাড়া দেয়। এমনও হয়েছে, দুটো বাড়িতে অগ্রিম টাকা দিয়েছি। দুটোই ফেরত নিতে হয়েছে। তৃতীয় যেই বাড়িটি ছিল, সেখানে তো এমন হয়েছে যে ইন্টেরিয়র হয়ে গেছে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা এসে বলে, ‘কাজ থামিয়ে দাও। আমি বাড়ি দিব না।’ তখন তাকে বলি, ‘আমি ব্যবসা শুরু করব। আপনি নিজে এখানে বসে থেকে দেখবেন। আপনার যদি কোনো অভিযোগ থাকে, আমি একদম কোনাে কথা না বলে ব্যবসা ছেড়ে নেমে যাব। এখন বললেই আমি বন্ধ করতে পারি না।’ পরে উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন।
ডিভোর্স হওয়ার পর ভীষণ কাঁদতাম। মনে হতো, আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলব। ধীরে ধীরে সন্তানের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হলো, বাচ্চাটার জন্য আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। একটা পুরুষের কাছে আমি হেরে যেতে পারি না। হেরে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। এরপর আবার উঠে দাঁড়ালাম। কাজ করা শুরু করলাম। ভীষণভাবে কাজে ডুবে যাই।
বাচ্চাটা তার বাবাকে খুব মিস করত। বাবাকে ফোন করে বলত, ‘তুমি কিছুক্ষণের জন্য আমার কাছে আসো। এসে খেলা করে যাও। দরকার হলে মা তখন বাসায় থাকবে না।’ এমনভাবে বাবাকে কাছে চাইত যে তখন মনে হলো, ছেলের একটা বাবা চাই। পরিবারের সবাই আমাকে বোঝাতে শুরু করল। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে হলো আমার। স্বামীর নাম উলফাত চৌধুরী রাতুল। তাদের পরিবার ও সে আমি ও আমার সন্তানকে খুব সুন্দরভাবে গ্রহণ করে। আলহামদুলিল্লাহ, এখন ভালো আছি।
নারীর পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়াতে চাই
রেডের ক্লায়েন্ট ভালো। কোভিডের কারণে আমরা একটু পিছিয়ে গেলেও হাঁটি হাঁটি পা পা করে এটি ভালোভাবেই চলছে। আর উজ্জ্বলার শুরুটা হয় নারীর পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছে নিয়ে। আমি একজন মা, আমার মতো এ রকম আরও মা-মেয়ে রয়েছেন, যারা সমাজে ভীষণ লড়াই করছেন। তাদের পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়াতে চাই।
কীভাবে একজন নারী বিউটি আর্টিস্ট হবে, কীভাবে সে পারসোনাল ও প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে ভারসাম্য আনবে এবং ব্যবসাটাকে সফলভাবে ধরে রাখবে- সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি উজ্জ্বলায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্তির আধার
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা আর কী লড়াই করছি। এর চেয়ে বেশি লড়াই-সংগ্রাম করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট কালরাতে তিনি সম্পূর্ণ পরিবারকে হারিয়েছেন। এরপরও টিকে আছেন এবং শক্তভাবে, যোগ্যতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন। তাকে দেখলে তো আর কিছুই লাগে না। তিনিই শক্তি।
নারীদের থামলে চলবে না
যতই শিক্ষিত-যোগ্য হোক না কেন, একজন নারীকে কেবল নারী হওয়ার কারণে বাধার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু থামলে চলবে না। এগোতে হবে। সৎভাবে, পরিশ্রমী হয়ে কাজ করলে সফলতা আসবে।