নাসির উদ্দিন টগর
আত্মহত্যা হলো নিজের জীবন নিজে সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া। ‘কমিট’ শব্দটির যথাযথতা সম্পর্কে এবং আত্মহত্যা বর্ণনা করার বিষয়ে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে নিজেকে মেরে ফেলাই হলো আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা ইংরেজি suicide (সুইসাইড), লাতিন suicidear (সুইসাইডেয়ার) থেকে এসেছে। এর অর্থ নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ ‘আত্মহত্যা’ করেন, জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করেন।
প্রাচীন এথেন্সে কোনো ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া আত্মহত্যা করত, তাহলে তাকে সাধারণ কবরস্থানে কবর দেয়ার অনুমতি প্রদান করা হতো না। আত্মহত্যা খ্রিষ্টান ইউরোপীয় অঞ্চলে একটি পাপ হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। ৪৫২ সালে আরলসের কাউন্সিলে আত্মহত্যাকে শয়তানের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ফ্রান্সের লুই চতুর্দশের ১৬৭০ সালে তৈরি করা ফৌজদারি অধ্যাদেশ অত্যন্ত অমানবিক ছিল। আত্মহত্যা করা ব্যক্তির মৃতদেহ রাস্তায় টেনে আনা হতো। মাথা নিচু করে তারপর আবর্জনা দিয়ে আবৃত করা হতো। ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জব্দ করা হতো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। পৃথিবীতে মৃত্যুর যত কারণ রয়েছে, আত্মহত্যা এর মধ্যে ত্রয়োদশতম। কিশোর-কিশোরী ও যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা।
রেনেসাঁসের সময় থেকে আত্মহত্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে শুরু করে। ডেভিড হিউম প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কেন আমি একটি করুণ অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করব, কিছু অসার সুবিধা, যা জনসাধারণ হয়তো আমার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে?’
আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক ভারসাম্যহীনতার যোগসূত্র রয়েছে। যারা বা যাদের সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের পূর্ণ আত্মহত্যা করার ঝুঁকি ৮ দশমিক ৬ ভাগ। বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকলে আত্মহত্যার ২০ গুণ বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া সিজোফ্রেনিয়া ১৪ পার্সেন্ট। ট্রোমাউত্তর স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, দ্বিপক্ষীয় ব্যাধি, স্থূলতাজনিত রোগ ইত্যাদি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের সামাজিক বন্ধন অটুট নয় এই আধুনিক গ্লোবাল ভিলেজের পৃথিবীতে। গ্লোবালাইজেশন যত আমাদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের, এক জায়গায় বসে অন্য জায়গায় যেভাবে কানেক্টেড করেছে, তা বাস্তবে ঠিকই করছে; কিন্তু এখানে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। আমরা যত ডিজিটালাইজশনে প্রবেশ করছি, আমাদের সামাজিক বন্ধনগুলো তত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো জায়গায় এখন কয়েকজন কথা বললে নিজেদের সঙ্গে যতটা না কথা বলি, তার চেয়ে বেশি খেয়াল করি হাতে থাকা স্মার্ট ডিভাইসটিকে। আমরা আমাদের শহর থেকে খেলার মাঠ উঠিয়ে ফেলছি। গ্রামকে স্মল টাউন, কোথাও কোথাও মিনি সিটি বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। বলছি না যে, এসব অপ্রয়োজনীয়। এসব অবশ্যই প্রয়োজন, তবে দিন শেষে যেন মানুষ মানুষেরই থাকে, কোনো স্মার্ট ডিভাইসের না হয়ে ওঠে। এত এত মানুষ আত্মহত্যা করছে এর অন্যতম কারণ হলো, অনলাইনে সময় দিয়ে অনিদ্রার অভ্যাস গড়ে তোলা আর অনিদ্রা হলে ডিপ্রেশনসহ প্রেশারের সমস্যা হয়, আমরা সবাই তা জানি। আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল অবলম্বন করতে হবে এসব বিষয়।
কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক সমস্যা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বোঝাপড়ার জায়গা করতে হবে। পরিবার সকলে সকলের সঙ্গে সময় বণ্টন শেয়ারিং-কেয়ারিংয়ের জায়গা তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি বলতে তাই মানুষ আমরা। আমরা রোবট নই। আমরা গুহা জীবন থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে সমাজ তৈরি করেছি। নিজেরা নিজেদের রক্ষা করেই টিকে রয়েছি পৃথিবীতে। আমাদের পুনরায় রক্ষা করতে হবে নিজেদের। চর্চা করতে হবে মন-মননের শান্তি কোথায়-কীভাবে অর্জন করতে বা করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র :
১. ভেভিড হিউমের প্রবন্ধ ও লেখনী।
২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইট।
৩. এমআইটি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মেন্টাল হেলথবিষয়ক জার্নাল ও ওয়েবসাইট।
লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ