ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কখনো কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করেছেন?’ সবার আগে উত্তরে কী বলবেন? ‘আমরা প্রতিদিনই ট্রাফিক জ্যামে বসে অপেক্ষা করি, জ্যাম কখন ছুটবে, কখন পৌঁছাবো!’
আবার কখনো হয়তো লিফটের জন্য, ঘরে ফিরে ডোর বেল চেপে, ফোনে অপর পক্ষের হ্যালো শোনার জন্য, ডাক্তারের কাছে গেলে, পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য, অনলাইনে অর্ডার করে ডেলিভারিম্যান আসার জন্য অপেক্ষা করি। আসলে এগুলো আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে গেছে।
তবে চাকরির পরীক্ষার অপেক্ষমান তালিকায় নিজের নাম দেখলে সত্যিই তা আশাহত হবার মতো বিষয়। আবার প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা বেশ মধুর আর রোমান্টিকও বটে। তবে অপেক্ষারত সময়ের মাত্রা কমবেশির কারণে বদলে যেতে পারে আমাদের আবেগ, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সম্পর্ক।
এ জন্যই এটি শেখাটাও হতে পারে একটি দক্ষতা।
অপেক্ষা কী?
অপেক্ষা হচ্ছে অনির্দিষ্ট, তবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য! অপেক্ষার শুরু খেয়াল করা যায়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Wait। যেমন, আমি ১ ঘণ্টা ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি নির্দিষ্ট সময় ‘১ ঘন্টা’ ধরে চলছে। ১ ঘণ্টা পর অপেক্ষার অবসান হবে বলে মনে করছি। অন্যদিকে, প্রতীক্ষা হচ্ছে দীর্ঘ সময়ের জন্য। সাধারণত এর শুরুটা আমাদের জানা থাকে না। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ-ও Wait। যেমন, আমি ২ বছর ধরে প্রতীক্ষায় রয়েছি! এটি দীর্ঘ ও অনির্দিষ্ট।
কেনো আমরা স্বেচ্ছায় অপেক্ষা করি
সাধারণত আমরা কিছু পাবার আশায় অপেক্ষা করি। যেমন, ফসলের বীজ বুনি, চাষ করি, যত্ন নেই, শ্রম দিই। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ফসল ঘরে তুলবো সেই আশায়।
অপেক্ষা করা কেন শিখবো?
কথায় আছে, ‘সবুরে মেওয়া ফলে!’ একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা যে জিনিস সহজেই পেয়ে যাই তার মর্ম বুঝি না। মাথা ঠান্ডা রেখে, ধৈর্য ধরে পরিশ্রম করে গেলে সফলতা আসবেই। আর তাই অপেক্ষা করতে শেখা জরুরি।
অপেক্ষা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। আমার প্রতিটি আচরণই ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। তাই অপেক্ষারত অবস্থায় হিতাহিতজ্ঞান শূন্য আচরণ করলে তা আমার শিক্ষা, মান-মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। ধৈর্য জীবনের সন্তুষ্টির সঙ্গে যুক্ত।
কীভাবে অপেক্ষা করবো?
আজকাল আমরা এক সেকেন্ড ইন্টারনেট কানেকশন না থাকলেই অস্থির হয়ে যাই। লোডশেডিং হলে কীভাবে কী করবো ভেবে অন্যের ওপর রেগে যাই। ধরুন, আপনি একটি লম্বা লাইনে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন আর আপনার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একটু ভেবে দেখুন, মেজাজ খারাপ হবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে, ঘাম হচ্ছে, হৃৎকম্পন বেড়ে যাচ্ছে, কথা বলতে গেলে গলার স্বর উঁচুতে উঠে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে উদ্বেগ! এতে কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে নিজেরই।
কিছু ক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া হয়তো উপায়ই থাকে না। তাই এ সময়ে প্রথমে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করুন। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে বোঝান। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক সবকিছুর শেষ রয়েছে। তাই এই লাইন যতই দীর্ঘ হোক এক সময় শেষ হবে। তবে লম্বা লাইনের কারণ ও কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে খোঁজ খবর নিয়ে জানার চেষ্টা করুন। এই ফাঁকে জরুরি ফোন কল এবং অন্যান্য সম্ভাব্য কাজগুলো করে নেওয়া যায় কি না দেখুন। অর্থাৎ অপেক্ষারত সময়টুকুও যেনো অর্থবহ হয়। কারণ, বিশ্বাস করতে হবে, জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডই অমূল্য সম্পদ।
আজীবন অপেক্ষা নয়
একটি সুন্দর সকালের অপেক্ষায় আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে উঠি। কিন্তু আমি কী এক কাপ চা-এর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করবো? নিশ্চয়ই না! ধরুন, আপনার প্রিয়জন কেউ দেশের বাইরে থেকে ফিরলে নির্দিষ্ট কোনো আয়োজন হবে। সেই অপেক্ষায় রয়েছেন। তার ফিরে আশার সময়টা এতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে যে, আপনি আর অপেক্ষা করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে অপেক্ষারত অবস্থায় মন পরিবর্তন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে হুট করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিবার ও কাছের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করুন। জীবনের সিদ্ধান্তগুলো আবেগ ও যুক্তির যথার্থ সংমিশ্রণে নিন। জীবন যাতে সুন্দর হয় সে চেষ্টাই করতে হবে।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস।’ পরিশেষে, বলতে চাই অপেক্ষা কষ্টের হলেও তা অনুশীলন করুন। সফলতা অনিবার্য। ‘আমার এখনই চাই’ এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন।
লেখক : সাইকোলজিস্ট, প্রতিষ্ঠাতা সোনারতরী